টেস্টোস্টেরন হরমোন: কাজ, লক্ষণ, সমস্যা ও টেস্ট (সম্পূর্ণ গাইড)

testosterone

টেস্টোস্টেরন হল এক ধরনের যৌন হরমোন যা প্রধানত পুরুষদের অণ্ডকোষ থেকে উৎপাদিত হয়। এটি পুরুষের শারীরিক গঠন, লিঙ্গের বিকাশ, মাসল গঠন, হাড়ের ঘনত্ব এবং যৌন ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া, এটি শরীরের শক্তি, মনোযোগ ও মানসিক সুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

Table of Contents

যখন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ঠিক থাকে, তখন শরীর স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। কিন্তু হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন: লিঙ্গ শক্ত না হওয়া, কম যৌন ইচ্ছা, মাসল কমে যাওয়া, ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি। 

টেস্টোস্টেরন হরমোন কী?

 টেস্টোস্টেরন হল একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন যা পুরুষদের শরীরে বিশেষ কাজ করে। এটি শরীরের নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও ক্রিয়ার জন্য দায়ী।

টেস্টোস্টেরন কাকে বলে?

হরমোন হলো রসায়নিক পদার্থ যা শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে সৃষ্ট হয়ে রক্তের মাধ্যমে বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সঙ্কেত পাঠায় এবং তাদের কার্যক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।

টেস্টোস্টেরন হলো একটি স্টেরয়েড হরমোন যা পুরুষের প্রধান যৌন হরমোন হিসেবে কাজ করে। এটি পুরুষদের শারীরিক গঠন, যৌন অঙ্গের বিকাশ ও যৌন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কোথা থেকে উৎপন্ন হয়?

টেস্টোস্টেরন প্রধানত পুরুষের অণ্ডকোষ (Testis) থেকে উৎপন্ন হয়। অণ্ডকোষের লেডিগ সেল (Leydig cells) এই হরমোন তৈরি করে।

ছোট পরিমাণে টেস্টোস্টেরন উৎপন্ন হয় অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড (Adrenal glands) থেকেও, যা কিডনির উপরের অংশে থাকে। এই হরমোন পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের শরীরেও কম মাত্রায় থাকে।

টেস্টোস্টেরন নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কি থাকে?

হ্যাঁ, টেস্টোস্টেরন নারী এবং পুরুষ উভয়ের শরীরেই থাকে। তবে এর মাত্রা ও ভূমিকা ভিন্ন হয়।

নারীদের শরীরে টেস্টোস্টেরন কম মাত্রায় থাকে এবং এটি ওভারি (ovaries) ও অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড থেকে উৎপন্ন হয়। নারীদের শরীরেও টেস্টোস্টেরন গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি হাড়ের স্বাস্থ্য, পেশী গঠন এবং মস্তিষ্কের কাজের জন্য প্রয়োজন।

পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, যা পুরুষ বৈশিষ্ট্য যেমন দাড়ি, মাসল বৃদ্ধি, কণ্ঠস্বর গম্ভীর হওয়া ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয়। সাধারণত, পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ নারীদের থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি।

টেস্টোস্টেরন হরমোনের কাজ কী?

টেস্টোস্টেরন হরমোন শরীরের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, বিশেষ করে পুরুষদের শারীরিক গঠন ও যৌন স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

শারীরিক গঠনে ভূমিকা

টেস্টোস্টেরন মাসল ও হাড়ের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি মাসল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং হাড়কে শক্তিশালী করে হাড়ঘনত্ব বজায় রাখে। এর ফলে শরীরের ক্ষমতা ও স্থায়িত্ব বাড়ে।

মাসল ও হাড়ের গঠন

  • মাসল টিস্যুর বৃদ্ধিতে টেস্টোস্টেরন সাহায্য করে, যা পুরুষদের শরীরকে শক্তিশালী ও টেকসই করে তোলে।

  • হাড়ের মধ্যে ক্যালসিয়াম সংরক্ষণ বাড়ায়, ফলে হাড় ঘন ও মজবুত হয়।

চেহারায় পুরুষালি বৈশিষ্ট্য

টেস্টোস্টেরন পুরুষদের মুখমন্ডল ও শরীরে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে, যেমন:

  • গোঁফ ও দাড়ি আনা

  • কণ্ঠস্বর গম্ভীর হওয়া

  • শরীরের লোম বৃদ্ধি

  • লম্বা ও শক্তিশালী কাঁধের গঠন

উদাহরণস্বরূপ, কিশোরাবস্থায় টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধির ফলে ছেলেদের দাড়ি ও গোঁফ আসে এবং কণ্ঠস্বর গভীর হয়।

 

যৌন ক্ষমতায় টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা

টেস্টোস্টেরন পুরুষের যৌন ক্ষমতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • লিবিডো (যৌন আকাঙ্ক্ষা): টেস্টোস্টেরন লিবিডো বা যৌন ইচ্ছা বৃদ্ধিতে মূল ভূমিকা পালন করে। হরমোনের মাত্রা কমে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যেতে পারে।

  • ইরেকশন ও স্পার্ম উৎপাদন: টেস্টোস্টেরন ইরেকশন (লিঙ্গ শক্ত হওয়া) ও স্পার্ম (বীর্য) উৎপাদনে সহায়তা করে। এটি পুরুষ প্রজনন অঙ্গের স্বাভাবিক কাজের জন্য অপরিহার্য।

মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব

টেস্টোস্টেরন শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

  • মুড: টেস্টোস্টেরন কম হলে মানুষ দুঃখী, হতাশ বা বিরক্ত অনুভব করতে পারে।

  • আত্মবিশ্বাস: এই হরমোনের পর্যাপ্ত মাত্রা থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং মানুষ জীবনের নানা কাজে আগ্রহী হয়।

  • আগ্রহের ওপর প্রভাব: টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে গেলে মনোযোগ কমে যেতে পারে এবং কাজের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়।

উদাহরণস্বরূপ, কিছু পুরুষ টেস্টোস্টেরন কম থাকলে দীর্ঘসময় ক্লান্তি ও হতাশায় ভুগেন।

টেস্টোস্টেরন হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা কত?

 টেস্টোস্টেরনের স্বাভাবিক মাত্রা বয়স ও ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়। সঠিক মাত্রা থাকলে শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।

বয়সভেদে স্বাভাবিক মাত্রা

  • বয়ঃসন্ধিকাল (পিউবের্টি): এই সময় টেস্টোস্টেরনের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা পুরুষ বৈশিষ্ট্যের বিকাশে সাহায্য করে। সাধারণত ৩০০ থেকে ১২০০ ng/dL এর মধ্যে থাকে।

  • প্রাপ্তবয়স্ক: ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষদের স্বাভাবিক টেস্টোস্টেরন মাত্রা প্রায় ৪০০ থেকে ১০০০ ng/dL হয়।

টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে গেলে কী লক্ষণ দেখা যায়?

 টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে গেলে শরীর ও মানসিক অবস্থায় নানা পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে যৌন ও শারীরিক ক্ষেত্রে স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয়।

যৌন লক্ষণ

  • লিবিডো কমে যাওয়া: যৌন ইচ্ছা কমে যায়। আগ্রহ ও আকর্ষণ অনেক সময় থাকে না।

  • ইরেকশন সমস্যা: লিঙ্গ সঠিকভাবে শক্ত হয় না বা ইরেকশন ধরে রাখা কঠিন হয়। ফলে যৌনতা ব্যাহত হয়।

অতিরিক্ত লক্ষণ হিসেবে স্পার্ম উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা প্রজনন সমস্যার কারণ হয়।

শারীরিক লক্ষণ

টেস্টোস্টেরন কমে গেলে শারীরিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যেমন—

  • পেশী ক্ষয় ও দুর্বলতা: মাসল গঠন কমে যায়, ফলে শরীর দুর্বল ও অকার্যকর মনে হয়।

  • হাড় ক্ষয়: হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ভঙ্গুর ও ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি বাড়ে।

মানসিক লক্ষণ

হরমোনের ঘাটতি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে—

  • বিষণ্নতা: মেজাজ খারাপ, মন খারাপ ও দুঃখ অনুভূত হতে পারে।

  • ক্লান্তি: সারাদিন ক্লান্ত লাগা, শক্তি কমে যাওয়া।

  • উদাসীনতা: আগ্রহ, মনোযোগ ও জীবনের প্রতি উদাসীনতা দেখা দেয়।

এই লক্ষণগুলো টেস্টোস্টেরন কম থাকার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এবং সময়মতো চিকিৎসা না করলে জীবনমান নষ্ট হতে পারে।

টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার কারণ

টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এগুলো প্রধানত প্রাকৃতিক বয়স বৃদ্ধি, শারীরিক ও জীবনধারাগত কারণ এবং বিশেষ কিছু রোগ বা চিকিৎসার প্রভাব হিসেবে বিভক্ত করা যায়।

প্রাকৃতিক কারণ

বয়স বৃদ্ধির সাথে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সাধারণত ৩০ বছর বয়সের পর প্রতি বছর ১-২% হারে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন কমতে শুরু করে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা ‘এন্ড্রোপজেনিক হরমোন ডিক্লাইন’ (Andropause) নামে পরিচিত।

উদাহরণস্বরূপ, ৫০ বছর বয়সে একজন পুরুষের টেস্টোস্টেরন স্তর ২০-৩০% কমে যেতে পারে, যা শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কারণ হয়।

শারীরিক ও জীবনধারাগত কারণ

কিছু শারীরিক ও জীবনধারাগত সমস্যা টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

  • স্থূলতা (Obesity): অতিরিক্ত শরীরের চর্বি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। বিশেষ করে, ফ্যাট টিস্যুতে অ্যারোমাটেজ এনজাইম (Aromatase enzyme) বেশি থাকে, যা টেস্টোস্টেরনকে ইস্ট্রোজেনে রূপান্তরিত করে।

  • স্ট্রেস (Stress): দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কোর্টিসল হরমোন বাড়িয়ে টেস্টোস্টেরন কমিয়ে দেয়।

  • ঘুমের অভাব (Sleep deprivation): পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, শরীরের হরমোন উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে। ঘুমের সময় টেস্টোস্টেরনের স্রোত বেশি হয়, তাই ঘুম কম হলে হরমোনের মাত্রাও কমে যায়।

  • অপুষ্টি (Malnutrition): প্রোটিন, ভিটামিন ডি, জিঙ্কের অভাব টেস্টোস্টেরন উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে।

রোগ বা চিকিৎসাজনিত কারণ

কিছু বিশেষ রোগ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি টেস্টোস্টেরন কমার কারণ হতে পারে—

  • ডায়াবেটিস (Diabetes mellitus): দীর্ঘস্থায়ী শর্করারোগ পুরুষদের টেস্টোস্টেরন কমায়।

  • ক্যান্সার থেরাপি (Cancer therapy): কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি টেস্টিসের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

  • টেস্টিস ইনজুরি (Testicular injury): অণ্ডকোষে সরাসরি আঘাত হরমোন উৎপাদন ব্যাহত করে।

  • হাইপোগোনাডিজম (Hypogonadism): টেস্টিস বা পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যায় টেস্টোস্টেরন কমে যায়।

টেস্টোস্টেরন হরমোন কম থাকলে শরীরে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

টেস্টোস্টেরনের অভাব শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।

দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব

টেস্টোস্টেরন কম হলে ব্যক্তির শরীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা কমে যায়।

  • কর্মক্ষমতা হ্রাস: মাসল শক্তি কমে যায়, কাজের গতি ও কার্যক্ষমতা ধীর হয়।

  • ক্লান্তি: শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শক্তি স্বল্পতা ও অলসতা বৃদ্ধি পায়।

  • মনোযোগ কমে যাওয়া: কাজের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ কমে যায়, যা পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

  • মেজাজ পরিবর্তন: বিষণ্নতা, হতাশা ও উদ্বেগ দেখা দিতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা

টেস্টোস্টেরন কম থাকা দীর্ঘদিন ধরে চললে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে—

  • অস্টিওপরোসিস (Osteoporosis): হাড়ের ঘনত্ব কমে গিয়ে হাড় ভঙ্গুর ও ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। টেস্টোস্টেরন হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

  • হার্টের সমস্যা: হরমোনের অভাব কারনে হৃদরোগ ও রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টোস্টেরন কম হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

  • ইনফার্টিলিটি (Infertility): স্পার্ম উৎপাদন কমে যায়, ফলে সন্তান ধারণে অসুবিধা হয়।

  • মেটাবলিক সিন্ড্রোম: স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ও উচ্চ রক্তচাপের সমষ্টিগত সমস্যা যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

উদাহরণস্বরূপ, একজন মাঝবয়সী পুরুষ যিনি টেস্টোস্টেরনের অভাবে দীর্ঘসময় ক্লান্ত ও বিষণ্ণ থাকেন, তিনি অস্টিওপরোসিস ও হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

টেস্টোস্টেরন হরমোন কম হলে কি লিঙ্গ শক্ত হয় না?

টেস্টোস্টেরন পুরুষদের প্রধান পুরুষ হরমোন, যা লিঙ্গের ইরেকশন বা শক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও ইরেকশন শুধুমাত্র টেস্টোস্টেরনের ওপর নির্ভরশীল নয়, তবুও এর ঘাটতি ইরেকশন সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ।

ইরেকশন সমস্যায় টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা

ইরেকশন হল একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশের সমন্বয় প্রয়োজন:

  • টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা:

    • টেস্টোস্টেরন লিঙ্গের গঠন এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ইরেকশন সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

    • এটি যৌন আকাঙ্ক্ষা বা লিবিডো (Libido) বাড়ায়, যা মানসিক উৎসাহ যোগায়।

    • টেস্টোস্টেরন কমে গেলে, রক্তনালীর স্বাস্থ্য কমে যেতে পারে এবং স্নায়ুর কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়, যা ইরেকশন কমজোরি সৃষ্টি করে।

  • শারীরিক ফ্যাক্টর:

    • রক্তনালীর স্বাস্থ্য, স্নায়ুর কাজ, হরমোনের মাত্রা এবং পেশীর কার্যক্ষমতা ইরেকশনে প্রভাব ফেলে।

    • উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ইত্যাদি শারীরিক অসুস্থতাও ইরেকশন সমস্যা তৈরি করে।

  • মানসিক ফ্যাক্টর:

    • উদ্বেগ, চাপ, বিষণ্নতা এবং সম্পর্কের সমস্যা ইরেকশনে বাধা সৃষ্টি করে।

    • টেস্টোস্টেরনের অভাব মানসিক চাপ ও মুড পরিবর্তন ঘটায়, যা যৌন সক্ষমতা হ্রাস করে।

চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা

টেস্টোস্টেরন কমে গেলে ইরেকশন সমস্যা হলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন। নিচের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি—

  • দীর্ঘদিন ধরে লিঙ্গ শক্ত না হওয়া বা ইরেকশন ধরে রাখতে না পারা।

  • যৌন ইচ্ছা (লিবিডো) কমে যাওয়া, যা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

  • অন্যান্য শারীরিক লক্ষণ যেমন ক্লান্তি, বিষণ্নতা, মাসল দুর্বলতা একসাথে দেখা দেওয়া।

  • আগেই ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে।

চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে—

  • হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি (Testosterone Replacement Therapy)

  • জীবনধারা পরিবর্তন (যেমন ঘুম ঠিক রাখা, স্বাস্থ্যকর খাবার, ব্যায়াম)

  • মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা

  • অন্যান্য চিকিৎসা যা শারীরিক রোগের কারণে ইরেকশন সমস্যা হলে প্রয়োজন হয়

সুতরাং, টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সঠিক পরীক্ষা ও চিকিৎসা করানো উচিত। কারণ সময়মতো চিকিৎসা ইরেকশন সমস্যা ও অন্যান্য জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।

টেস্টোস্টেরন হরমোন বেশি হলে কী হয়?

টেস্টোস্টেরনের স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হরমোন থাকলেও শরীরে বিভিন্ন অস্বস্তি ও সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এটি শরীরের বিভিন্ন অংশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে।

অপ্রাকৃত বৃদ্ধির লক্ষণ

টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত স্রোত শরীরে কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ সৃষ্টি করে, যেমন—

  • মুড সুইং (Mood swings): হঠাৎ হঠাৎ রাগ, উত্তেজনা বা হতাশায় ভুগতে পারে।

  • আগ্রাসী আচরণ (Aggressiveness): অতিরিক্ত ক্রোধ বা সহিংস প্রবণতা দেখা দেয়।

  • ব্রণ (Acne): ত্বকের তেল উৎপাদন বেড়ে ব্রণ ও ত্বকের সমস্যা বাড়ে।

  • অস্থিরতা ও ঘুমের সমস্যা: ঘুম কমে যাওয়া ও অস্থিরতা বেড়ে যায়।

  • প্রচণ্ড যৌন আকাঙ্ক্ষা: যৌন ইচ্ছা বেশি হওয়া ও অস্বাভাবিক হয়ে ওঠা।

স্বাস্থ্য ঝুঁকি

টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত মাত্রা কিছু গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে—

  • হার্ট অ্যাটাক (Heart attack): উচ্চ মাত্রার টেস্টোস্টেরন রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বাড়িয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।

  • লিভার সমস্যা (Liver problems): হরমোন বেশি থাকলে লিভারে সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন লিভার সেল ক্ষতি।

  • বন্ধ্যাত্ব (Infertility): টেস্টোস্টেরন বেশি হলে শরীর নিজস্ব স্পার্ম উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে, ফলে সন্তান ধারণে সমস্যা হয়।

  • রক্তজমাট বাঁধা (Blood clots): রক্ত সান্দ্রতা বেড়ে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি থাকে।

  • গোলযোগ কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমে (Cardiovascular system issues): হৃদপিণ্ড ও রক্তনালীর সমস্যা দেখা দিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, যারা অনিয়ন্ত্রিত হরমোন থেরাপি বা স্টেরয়েড গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়।

ছেলেদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বেড়ে গেলে কী হয়?

টেস্টোস্টেরন হরমোন ছেলেদের শরীরের বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে হরমোন অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলে তা শরীর ও মানসিক অবস্থায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

কৈশোরে অস্বাভাবিক লক্ষণ

কিশোর বয়সে টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হলে কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয়—

  • অতিরিক্ত লোম গজানো: শরীর ও মুখে বেশি মাত্রায় লোম ওঠা, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।

  • কণ্ঠ পরিবর্তন: কণ্ঠস্বর দ্রুত বা অস্বাভাবিকভাবে গভীর হয়ে যাওয়া।

  • ব্রণ: ত্বকে ব্রণ বেশি হওয়া।

  • শরীরের বৃদ্ধি: হাড় ও মাসলের অস্বাভাবিক দ্রুত বৃদ্ধি।

  • আগ্রাসী বা অতিরিক্ত রাগ: আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন ও মানসিক উত্তেজনা।

প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রার প্রভাব

বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে টেস্টোস্টেরনের অতিরিক্ত মাত্রা হলে—

  • স্পার্ম কাউন্ট কমে যাওয়া: শরীর নিজস্ব স্পার্ম উৎপাদন হ্রাস করতে পারে, ফলে উর্বরতা সমস্যা হতে পারে।

  • চুল পড়া: পুরুষ ধরনীয় মাথার চুল পড়া বা পাতলা হওয়া দ্রুত বাড়তে পারে।

  • ব্রণ ও ত্বকের সমস্যা: ত্বকে অতিরিক্ত তেল উৎপাদন ও ব্রণের সমস্যা বাড়তে পারে।

  • মেজাজ পরিবর্তন: উদ্বেগ, রাগ বা মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।

  • হৃদরোগ ঝুঁকি বৃদ্ধি: রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।

টেস্টোস্টেরন হরমোন লেভেল কীভাবে টেস্ট করা হয়?

টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা সবচেয়ে সাধারণ এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। সঠিক সময়ে এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় নমুনা সংগ্রহ করলে ফলাফল সঠিক হয়।

কোন সময় রক্ত পরীক্ষা করা ভালো?

  • সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করা উত্তম।

  • এই সময় টেস্টোস্টেরনের স্তর সর্বোচ্চ থাকে।

  • বিকালে হরমোনের মাত্রা কমে যেতে পারে, তাই সকালে টেস্ট করানো বেশি নির্ভুল ফল দেয়।

কীভাবে নমুনা নেয়া হয়?

  • হাতের নরম সূঁচ দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।

  • সাধারণত ভেনাস ব্লাড (Venous blood) নেওয়া হয়।

  • নমুনা সংগ্রহের পর ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়।

রিপোর্ট বুঝার নিয়ম

টেস্টোস্টেরনের রিপোর্টে দুটি প্রধান মান থাকে—

  • Total Testosterone (মোট টেস্টোস্টেরন): শরীরে টেস্টোস্টেরনের মোট পরিমাণ, যা প্রোটিনের সাথে যুক্ত এবং মুক্ত উভয় ফর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে।

  • Free Testosterone (মুক্ত টেস্টোস্টেরন): শরীরে সক্রিয় এবং ব্যবহারযোগ্য টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ, যা প্রোটিনের সাথে যুক্ত নয়।

উদাহরণ:

  • যদি মোট টেস্টোস্টেরন স্বাভাবিক হলেও মুক্ত টেস্টোস্টেরন কম থাকে, তাহলে শরীর পর্যাপ্ত হরমোন পায় না।

  • তাই মুক্ত টেস্টোস্টেরনের মান বোঝা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

টেস্টোস্টেরন হরমোন টেস্ট খরচ বাংলাদেশে

বাংলাদেশে টেস্টোস্টেরন হরমোনের রক্ত পরীক্ষা করার খরচ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন হতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্রের মধ্যে মূল্য পার্থক্য থাকে।

সরকারি ও বেসরকারি খরচের পরিসীমা

  • সরকারি হাসপাতালে সাধারণত টেস্টের খরচ কম হয়।

  • বেসরকারি ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খরচ কিছুটা বেশি হতে পারে।

  • গড় খরচ ৬০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

  • নির্ভর করে পরীক্ষা করার ধরণ (Total Testosterone, Free Testosterone) ও ল্যাবের উপর।

কোথায় টেস্ট করানো যায়?

  • ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে অনেক জনপ্রিয় ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যেমন—

    • এপোলো, ইউনাইটেড, ডায়াগনস্টিক সেন্টার

    • সরকারী হাসপাতাল যেমন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

  • অন্যান্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালেও পরীক্ষা করা যায়।

  • বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবগুলোতে দ্রুত রিপোর্ট পাওয়া যায়।

টেস্ট করানোর আগে প্রাথমিকভাবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে সঠিক ধরনের টেস্ট করানো হয়।

উপসংহার

টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষ ও নারীর শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন। এটি শারীরিক গঠন, যৌন ক্ষমতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ভূমিকা রাখে। টেস্টোস্টেরনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় না থাকলে বিভিন্ন সমস্যা যেমন লিবিডো কমে যাওয়া, পেশী দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ, ও হাড় ক্ষয় দেখা দিতে পারে। তাই হরমোনের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা জরুরি, বিশেষ করে যাদের শরীরিক পরিবর্তন বা যৌন সমস্যা দেখা দেয়।

এই টেস্টোস্টেরন পরীক্ষা করার মাধ্যমে সময়মতো সমস্যা শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যা শরীর ও মন দুই দিক থেকেই ভালো রাখতে সাহায্য করে। যারা উচ্চ বয়সের, যাদের অতিরিক্ত ওজন, ঘুমের সমস্যা বা মানসিক চাপ বেশি, কিংবা যাদের ডায়াবেটিস বা অন্যান্য রোগ রয়েছে তাদের জন্য এই পরীক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সচেতনতা বাড়িয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করলে টেস্টোস্টেরনের অস্বাভাবিকতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।



Shopping Cart
Scroll to Top