ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা IBS হলো একটি সাধারণ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে। এটি একটি কার্যকরী ব্যাধি (functional disorder) হিসেবে পরিচিত, যার অর্থ হলো অন্ত্রের গঠন স্বাভাবিক থাকলেও এর কার্যকারিতায় সমস্যা দেখা দেয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এর উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা IBS-এর গভীর বিশ্লেষণ, এর প্রকারভেদ, লক্ষণ, মূল কারণ, ঝুঁকির কারণ, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং কার্যকরী চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) কী?
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) মূলত একটি ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা, যা বৃহদন্ত্রকে (Colon) প্রভাবিত করে। এটিকে স্প্যাস্টিক কোলনও বলা হয়। IBS-এর ক্ষেত্রে অন্ত্রের সংবেদনশীলতা বেড়ে যায় এবং অন্ত্রের পেশীগুলোর স্বাভাবিক ছন্দে সংকোচন-প্রসারণের ভারসাম্য নষ্ট হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, IBS অন্ত্রের টিস্যুর কোনো ক্ষতি করে না বা কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় না, যা এটিকে ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD) যেমন—ক্রোন’স ডিজিজ বা আলসারেটিভ কোলাইটিস থেকে আলাদা করে।
IBS-এর প্রকারভেদ (Types of IBS)
উপসর্গের ধরনের ওপর ভিত্তি করে IBS-কে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:
-
ডায়রিয়া প্রধান IBS (IBS-D): এক্ষেত্রে রোগীর ঘন ঘন, পাতলা এবং জলীয় মলত্যাগের প্রবণতা দেখা যায়। পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্পিং প্রায়শই মলত্যাগের সাথে সম্পর্কিত থাকে।
-
কোষ্ঠকাঠিন্য প্রধান IBS (IBS-C): এই ধরনের রোগীরা অনিয়মিত এবং কঠিন মলত্যাগের সমস্যায় ভোগেন। মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হয় এবং পেট পুরোপুরি পরিষ্কার না হওয়ার অনুভূতি থাকে।
-
মিশ্র প্রকৃতির IBS (IBS-M): এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে ডায়রিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য উভয় উপসর্গই পর্যায়ক্রমে দেখা যায়।
IBS-এর সাধারণ লক্ষণসমূহ
IBS-এর লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে কিছু সাধারণ উপসর্গ প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখা যায়:
-
পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প: ব্যথা সাধারণত তলপেটে হয় এবং মলত্যাগের পর সাময়িকভাবে কমে যায়।
-
ফুলে যাওয়া এবং গ্যাস (Bloating and Gas): পেট ভরা বাแน่น থাকার অনুভূতি এবং অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হওয়া একটি সাধারণ লক্ষণ।
-
ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য: উপরে উল্লিখিত প্রকারভেদ অনুযায়ী যেকোনো একটি বা উভয়ই থাকতে পারে।
-
মলের প্রকৃতির পরিবর্তন: মলের আকৃতি (শক্ত, পাতলা) এবং প্রকৃতির (আম বা শ্লেষ্মা যুক্ত) পরিবর্তন হতে পারে।
-
অসম্পূর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি: মনে হয় যেন মলত্যাগ করার পরেও পেট পুরোপুরি খালি হয়নি।
কখন দ্রুত ডাক্তার দেখাবেন? (Red Flag Symptoms)
কিছু উপসর্গ IBS-এর বাইরেও গুরুতর রোগের ইঙ্গিত দিতে পারে। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:
-
মলদ্বার থেকে রক্তপাত।
-
রাতে ডায়রিয়া বা পেটে ব্যথা হওয়া।
-
কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
-
আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতা (Iron deficiency anemia)।
-
অকারণে বমি হওয়া।
-
খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া।
IBS-এর সম্ভাব্য কারণ এবং ট্রিগার
IBS-এর কোনো একক নির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি, তবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়:
-
মস্তিষ্ক-অন্ত্রের সংযোগ (The Brain-Gut Axis): মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের মধ্যে একটি শক্তিশালী স্নায়বিক সংযোগ রয়েছে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতার মতো মানসিক অবস্থা সরাসরি অন্ত্রের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং IBS-এর উপসর্গ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
-
অন্ত্রের পেশী সংকোচন: অন্ত্রের প্রাচীরের পেশীগুলো খাবার হজম করার জন্য সংকুচিত এবং প্রসারিত হয়। IBS রোগীদের ক্ষেত্রে এই সংকোচন অতিরিক্ত শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী (ডায়রিয়ার কারণ) বা দুর্বল (কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ) হতে পারে।
-
অন্ত্রের প্রদাহ (Low-grade Inflammation): কিছু IBS রোগীর অন্ত্রের প্রাচীরে ইমিউন কোষের (immune cells) সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে দেখা যায়, যা হালকা প্রদাহ এবং ব্যথার কারণ হতে পারে।
-
গুরুতর ইনফেকশন: ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের কারণে তীব্র ডায়রিয়া (গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস) হওয়ার পরেও অনেকের মধ্যে পোস্ট-ইনফেকশাস আইবিএস (Post-infectious IBS) তৈরি হতে পারে।
-
অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম (Gut Microbiome): অন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী এবং অপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতা IBS-এর কারণ হতে পারে।
-
খাদ্য সংবেদনশীলতা (Food Sensitivity): কিছু নির্দিষ্ট খাবার যেমন—গম, দুগ্ধজাত পণ্য, সাইট্রাস ফল, শিম, বাঁধাকপি এবং কৃত্রিম মিষ্টিজাতীয় খাবার অনেকের ক্ষেত্রে IBS-এর উপসর্গ বাড়িয়ে তোলে।
ঝুঁকির কারণসমূহ (Risk Factors)
কিছু নির্দিষ্ট বিষয় IBS হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়:
-
বয়স: সাধারণত ৫০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
-
লিঙ্গ: নারীদের মধ্যে IBS-এর হার পুরুষদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে মাসিক চক্রের সময়, উপসর্গ বাড়াতে পারে।
-
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারে কারও IBS থাকলে ঝুঁকি বাড়তে পারে, যা জেনেটিক বা পরিবেশগত কারণের দিকে ইঙ্গিত করে।
-
মানসিক স্বাস্থ্য: উদ্বেগ, বিষণ্ণতা বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে IBS-এর ঝুঁকি বেশি।
IBS রোগ নির্ণয় (Diagnosing IBS)
IBS নির্ণয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। এটি মূলত একটি “ডায়াগনোসিস অফ এক্সক্লুশন” (diagnosis of exclusion), যেখানে চিকিৎসক অন্যান্য সম্ভাব্য রোগ বাদ দিয়ে সিদ্ধান্তে আসেন।
-
রোগের ইতিহাস পর্যালোচনা: চিকিৎসক রোগীর লক্ষণ, খাদ্যাভ্যাস, এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করেন।
-
শারীরিক পরীক্ষা: শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে অন্য কোনো রোগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয়।
-
রোম মানদণ্ড (Rome Criteria): চিকিৎসকরা প্রায়ই এই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যবহার করেন। এটি অনুসারে, যদি গত তিন মাসে গড়ে সপ্তাহে অন্তত একদিন পেটে ব্যথা থাকে এবং তা মলত্যাগের সাথে সম্পর্কিত হয়, তবে তাকে IBS হিসেবে ধরা হতে পারে।
অন্যান্য গুরুতর রোগ (যেমন IBD বা ক্যান্সার) বাদ দেওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষা করা হতে পারে:
-
রক্ত পরীক্ষা: রক্তাল্পতা বা সিলিয়াক ডিজিজ পরীক্ষা করার জন্য।
-
মল পরীক্ষা: সংক্রমণ বা প্রদাহের চিহ্ন সনাক্ত করার জন্য।
-
কোলনস্কোপি বা সিগমায়েডোস্কোপি: যদি রোগীর বয়স বেশি হয় বা রক্তপাতের মতো গুরুতর লক্ষণ থাকে, তবে কোলনের ভেতরটা দেখার জন্য এই পরীক্ষাগুলো করা হয়।
IBS-এর কার্যকরী চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা
IBS নিরাময়যোগ্য না হলেও এর উপসর্গগুলো কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।
১. খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন
-
লো-FODMAP ডায়েট (Low-FODMAP Diet): এটি IBS ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে কার্যকরী পথ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। FODMAP হলো এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট যা সহজে হজম হয় না এবং অন্ত্রে গ্যাস ও ফোলাভাব সৃষ্টি করে।
উচ্চ-FODMAP খাবার (এড়িয়ে চলুন) | নিম্ন-FODMAP খাবার (গ্রহণযোগ্য) |
গম, রাই, পেঁয়াজ, রসুন | ওটস, ঢেঁকিছাঁটা চাল, গাজর, শসা, পালংশাক |
দুধ, দই, নরম চিজ | ল্যাকটোজ-মুক্ত দুধ, কাঠবাদামের দুধ, শক্ত চিজ |
আপেল, আম, নাশপাতি, মধু | কলা, কমলা, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি |
শিম, মটরশুঁটি, ডাল | মিষ্টি আলু, আলু |
-
ফাইবার: কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রে দ্রবণীয় ফাইবার (Soluble fiber) যেমন—ইসবগুলের ভুসি বা ওটস উপকারী। তবে অতিরিক্ত ফাইবার গ্যাস বাড়াতে পারে।
-
পর্যাপ্ত জল পান: দিনে ৮-১০ গ্লাস জল পান করা কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে।
-
নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক কার্যকলাপ অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়ায় এবং মানসিক চাপ কমায়।
২. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ (Stress Management)
যেহেতু মানসিক চাপ IBS-এর অন্যতম প্রধান ট্রিগার, তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য।
-
যোগব্যায়াম এবং ধ্যান: মন এবং শরীরকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
-
মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) বা হিপনোথেরাপি উপসর্গ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
-
পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম মস্তিষ্ক-অন্ত্রের সংযোগকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
৩. ঔষধপত্র (Medications)
যখন জীবনযাত্রার পরিবর্তন যথেষ্ট হয় না, তখন চিকিৎসক উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে কিছু ওষুধ দিতে পারেন:
-
কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য: জোলাপ (Laxatives) বা ফাইবার সাপ্লিমেন্ট।
-
ডায়রিয়ার জন্য: লোপেরামাইড (Loperamide)-এর মতো ওষুধ।
-
পেটে ব্যথার জন্য: অ্যান্টিস্প্যাসমোডিকস (Antispasmodics) যা অন্ত্রের পেশী শিথিল করে।
-
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য: মৃদু মাত্রার অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, যা অন্ত্রের স্নায়ুর সংবেদনশীলতা কমাতেও সাহায্য করে।
উপসংহার
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম একটি জটিল এবং অনেক সময় হতাশাজনক অবস্থা, কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সঠিক রোগ নির্ণয়, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এর উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। মনে রাখবেন, IBS নিয়ে একা ভোগার কোনো কারণ নেই। একজন বিশেষজ্ঞ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের সাহায্য নিলে আপনি একটি স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারবেন।