ফল

ফল: সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উদাহরণ এবং শ্রেণীবিভাগ

ফল কী তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে, প্রথমে এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক এবং রন্ধনসম্পর্কীয় সংজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের জগতে, ফলের একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে: এটি একটি সপুষ্পক উদ্ভিদের পরিপক্ব, বীজ-ধারণকারী গর্ভাশয় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে, রন্ধনসম্পর্কীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘ফল’ শব্দটি সাধারণত সেই সকল উদ্ভিদের অংশকে বোঝায় যা মিষ্টি এবং প্রধান খাবারের পরে খাওয়া হয়।

এই সংজ্ঞার পার্থক্যের অর্থ হলো যে, অনেক জিনিসকে আমরা সবজি হিসাবে বিবেচনা করি, সেগুলো উদ্ভিদবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী ফল। যেমন – টমেটো, শসা, এবং মরিচ। এই বস্তুগুলিকে তাদের মিষ্টতা এবং খাবারে তাদের ভূমিকার উপর ভিত্তি করে সবজি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। উদ্ভিদতাত্ত্বিক ফল এবং রন্ধনসম্পর্কীয় ফলের মধ্যে সম্পর্কটি হলো—একটি উদ্ভিদতাত্ত্বিক ফলকে তার ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে রন্ধনসম্পর্কীয় সবজি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে।

উদ্ভিদতাত্ত্বিকভাবে ফল কিন্তু সবজি হিসাবে পরিচিত কিছু উদাহরণ:

  • টমেটো

  • শসা

  • বেল পেপার

  • বেগুন

  • স্কোয়াশ

  • কুমড়া

  • সবুজ বিনস

  • ভুট্টার দানা

  • ঢেঁড়স

ফলের বিকাশ এবং গঠন প্রণালী

ফলের বিকাশ এবং গঠন প্রক্রিয়াটি উদ্ভিদের পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মূলত ফুল এবং বীজের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো:

ফুলের প্রজনন কেন্দ্র

প্রতিটি ফলের উৎস হলো ফুল। ফুলের স্ত্রী প্রজনন অঙ্গটিকে গর্ভকেশর (Carpel) বলা হয়, যা একটি ফলের বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। গর্ভকেশর মূলত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত: গর্ভাশয় (Ovary), যা ফলের মূল অংশ গঠন করে; গর্ভদণ্ড (Style), যা একটি নলের মতো অংশ; এবং গর্ভমুণ্ড (Stigma), যা শীর্ষে অবস্থান করে এবং পরাগ গ্রহণ করে।

পরাগায়াণ এবং নিষেক

ফলের বিকাশের জন্য পরাগায়াণ এবং নিষেক অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়ায়, পরাগরেণু (Pollen) গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তরিত হয় এবং গর্ভদণ্ডের মাধ্যমে গর্ভাশয়ের ভেতরে থাকা ডিম্বক (Ovules) পর্যন্ত পৌঁছায়। ডিম্বক নিষিক্ত হওয়ার পরেই গর্ভাশয়টি একটি ফলে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য সংকেত পায় এবং এর রূপান্তর শুরু হয়।

ফলের প্রাচীরের গঠন 

নিষিক্তকরণের পর ফুলের গর্ভাশয়টি বিকশিত হয়ে যে ফল তৈরি করে, তার প্রাচীরকে ফলত্বক (Pericarp) বলা হয়। ফলত্বক মূলত তিনটি স্তর নিয়ে গঠিত:

  • বহিস্ত্বক (Exocarp): এটি ফলের বাইরের ত্বক বা খোসা।

  • মধ্যত্বক (Mesocarp): এটি ফলের মধ্যবর্তী মাংসল এবং রসালো অংশ।

  • অন্তস্ত্বক (Endocarp): এটি ফলের সবচেয়ে ভেতরের স্তর, যা অনেক সময় বীজকে ঘিরে একটি শক্ত আবরণ বা আঁটি (pit/stone) তৈরি করে।

উৎস অনুসারে ফলের শ্রেণিবিন্যাস

উদ্ভিদতাত্ত্বিকভাবে, ফুলের গঠন থেকে বিকাশের উপর ভিত্তি করে ফলকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম প্রধান বিভাগটি হলো সরল ফল। অন্যান্য বিভাগগুলো হলো গুচ্ছ ফল, যৌগিক ফল এবং অপ্রকৃত ফল।

  • সরল ফল (Simple Fruits): একটি ফুলের একটি মাত্র গর্ভাশয় থেকে বিকশিত হয়।

  • গুচ্ছ ফল (Aggregate Fruits): একটি ফুলের মধ্যে থাকা একাধিক পৃথক গর্ভাশয় থেকে বিকশিত হয়।

  • যৌগিক ফল (Multiple Fruits): একটি পুষ্পমঞ্জরির অনেকগুলো ফুলের মিলিত গর্ভাশয় থেকে বিকশিত হয়।

  • অপ্রকৃত ফল (Accessory Fruits): এটি একটি বৃহত্তর শ্রেণিবিভাগ যেখানে গর্ভাশয় ব্যতীত ফুলের অন্য অংশ (যেমন পুষ্পাধার) ফলের মাংসল অংশে পরিণত হয়।

সরল, গুচ্ছ এবং যৌগিক—এই তিনটি প্রধান প্রকার একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। অন্যদিকে, ‘অপ্রকৃত ফল’ এমন একটি বর্ণনামূলক শব্দ যা অন্য তিনটি বিভাগের যেকোনোটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।

বিস্তৃত শ্রেণিবিন্যাস সারণী:

ফলের প্রকার ফুলের উৎস গর্ভাশয়ের গঠন মূল বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত উদাহরণ
সরল একটি ফুল একটি গর্ভাশয় (সরল বা যৌগিক) একটি একক অংশ থেকে ফল বিকশিত হয় পীচ, আপেল, টমেটো, চেরি, জলপাই, মটরশুঁটি, অ্যাকর্ন
গুচ্ছ একটি ফুল অনেক পৃথক গর্ভাশয় ক্ষুদ্র “ফ্রুটলেট” (ড্রুপলেট, অ্যাকিন)-এর একটি গুচ্ছ রাস্পবেরি, ব্ল্যাকবেরি, স্ট্রবেরি, ম্যাগনোলিয়া, সাদার্ন পপ
যৌগিক অনেক ফুল অনেকগুলো মিলিত গর্ভাশয় (পুষ্পমঞ্জরি) সম্পূর্ণ পুষ্পমঞ্জরিটি একটি ফলে পরিণত হয় আনারস, ডুমুর, তুঁত, ওসেজ অরেঞ্জ, ব্রেডফ্রুট
অপ্রকৃত প্রযোজ্য নয় পরিবর্তনশীল মাংসল অংশে গর্ভাশয়-বহির্ভূত টিস্যু থাকে আপেল/নাশপাতি (পুষ্পাধার), স্ট্রবেরি (পুষ্পাধার), আনারস (অক্ষ), ডুমুর (সাইকোনিয়াম)

গঠন ও প্রকৃতি: রসালো এবং শুষ্ক ফলের মধ্যে মূল পার্থক্য

ফলের গঠন ও প্রকৃতি অনুযায়ী প্রধান দুই ধরনের ফল আছে: রসালো (Fleshy) এবং শুষ্ক (Dry)। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য নিচে তুলে ধরা হলো:

ক. রসালো ফল (মাংসল ফলত্বক)

বেরি (Berry): এর সম্পূর্ণ ফলত্বকই মাংসল হয়।

  • উদাহরণ: আঙুর, টমেটো, ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি, কলা (চর্মি বেরি), অ্যাভোকাডো (এক-বীজী বেরি)।

  • উপ-প্রকার:

    • পেপো (Pepo): শক্ত খোসাযুক্ত বেরি। উদাহরণ: তরমুজ, শসা, কুমড়া, লাউ, স্কোয়াশ।

    • হেসপেরিডিয়াম (Hesperidium): চামড়ার মতো পুরু খোসাযুক্ত বেরি। উদাহরণ: কমলা, লেবু, লাইম, জাম্বুরা, কুমকোয়াট।

ড্রুপ (Drupe) বা অষ্ঠিল ফল: এর মধ্যত্বক মাংসল এবং অন্তস্ত্বক শক্ত বা পাথরের মতো (আঁটি) হয়।

  • উদাহরণ: পীচ, প্লাম, চেরি, আম, জলপাই, খেজুর।

  • স্পষ্টীকরণ: নারকেল এবং আখরোট হলো তন্তুময় ড্রুপ।

পোম (Pome): এর মাংসল অংশটি মূলত অপ্রকৃত টিস্যু (ফুলের নলাংশ) দিয়ে গঠিত।

  • উদাহরণ: আপেল, নাশপাতি, কুইন্স, রোজ হিপ।

খ. শুষ্ক ফল (পরিপক্ক অবস্থায় শুষ্ক ফলত্বক)

বিদারণশীল ফল (Dehiscent Fruits) (ফেটে বীজ ছড়িয়ে দেয়):

  • লিগিউম (Legume): দুটি প্রান্ত বরাবর ফেটে যায়। উদাহরণ: শিম, মটর, মসুর, চিনাবাদাম, তেঁতুল।

  • ফলিকল (Follicle): একটি প্রান্ত বরাবর ফেটে যায়। উদাহরণ: আকন্দ, ম্যাগনোলিয়া, পিওনি, কলম্বাইন।

  • ক্যাপসুল (Capsule): সবচেয়ে সাধারণ প্রকার; বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফেটে যায়। উদাহরণ: পপি, আইরিস, ব্রাজিল নাট (উদ্ভিদগতভাবে এটি একটি ক্যাপসুলের বীজ, বাদাম নয়)।

  • সিলিক (Silique): ফেটে যাওয়ার সময় একটি কেন্দ্রীয় ঝিল্লি রেখে যায়। উদাহরণ: সরিষা, মূলা, বাঁধাকপি পরিবার।

অবিদারণশীল ফল (Indehiscent Fruits) (ফেটে যায় না):

  • অ্যাকিন (Achene): ছোট, এক-বীজযুক্ত এবং পাতলা ফলত্বকযুক্ত। উদাহরণ: সূর্যমুখী (এর “খোলসটি” হলো ফল), স্ট্রবেরি (এর বাইরের “বীজগুলো” হলো অ্যাকিন), বাকহুইট।

  • নাট (Nut) বা কাষ্ঠফল: শক্ত, কাষ্ঠল ফলত্বকযুক্ত একটি একক-বীজী ফল। উদাহরণ: অ্যাকর্ন, হ্যাজেলনাট, চেস্টনাট, বীচ। (স্পষ্টীকরণ: কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট রন্ধনশিল্পে বাদাম হলেও উদ্ভিদগতভাবে এরা ড্রুপ ফলের বীজ বা অংশ)।

  • সামারা (Samara): একটি ডানাযুক্ত অ্যাকিন। উদাহরণ: ম্যাপল, অ্যাশ, এলম।

  • ক্যারিওপসিস (Caryopsis) বা শস্য: ফলত্বকটি বীজত্বকের সাথে মিশে থাকে। উদাহরণ: ভুট্টা, গম, চাল, বার্লি।

ফলের জগতে বিশেষ ক্ষেত্র এবং সাধারণ ভুল ধারণা

ফলের জগতে কিছু বিশেষ ক্ষেত্র আছে যা সাধারণত শিক্ষার্থী ও চাষীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে। এখানে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো

বীজবিহীন ফলের রহস্য

বীজবিহীন ফলের অস্তিত্বের কারণ হলো পার্থেনোকার্পি (Parthenocarpy), যা নিষেক ছাড়াই ফল বিকাশের একটি প্রক্রিয়া। নেভেল কমলা এবং কলার মতো ফলগুলো এর অন্যতম উদাহরণ। কলার ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়াটি ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যেখানে উদ্ভিদের অঙ্গজ জননের মাধ্যমে নতুন গাছ তৈরি করা হয় এবং ফল বীজবিহীন থাকে।

সব “বেরি” আসলে বেরি নয়

সাধারণভাবে স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি এবং ব্ল্যাকবেরিকে বেরি বলা হলেও, উদ্ভিদবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুসারে এরা প্রকৃত বেরি নয়। এরা মূলত গুচ্ছ ফল (aggregate fruits), কারণ এগুলো একটি ফুলের একাধিক গর্ভাশয় থেকে তৈরি হয়, যেখানে প্রকৃত বেরি একটি মাত্র গর্ভাশয় থেকে বিকশিত হয়।

বাদামের বিভ্রান্তি

উদ্ভিদতাত্ত্বিক বাদাম এবং প্রচলিত বা রন্ধনসম্পর্কীয় বাদামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নিচের সারণীতে এই পার্থক্যটি स्पष्ट করা হলো:

নাম রন্ধনসম্পর্কীয় বিভাগ উদ্ভিদতাত্ত্বিক শ্রেণিবিন্যাস
হ্যাজেলনাট বাদাম প্রকৃত বাদাম (True Nut)
অ্যাকর্ন (সাধারণ নয়) প্রকৃত বাদাম (True Nut)
কাঠবাদাম বাদাম ড্রুপ (বীজ)
আখরোট বাদাম ড্রুপ (বীজ)
পেকান বাদাম ড্রুপ (বীজ)
চিনাবাদাম বাদাম লিগিউম (ফল)
পেস্তা বাদাম ড্রুপ (বীজ)

শুধু খাবার নয়: ফলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

ফল শুধু খাওয়ার উপাদান নয়; এটি উদ্ভিদ, পরিবেশ, এবং মানুষের জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে তা সংক্ষেপে দেখানো হলো:

প্রকৃতির বিস্তারের কৌশল

ফলের প্রধান কাজ হলো বীজের বিস্তার ঘটানো, যা উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এই বিস্তার বিভিন্ন উপায়ে সাধিত হয়, যেমন—বাতাসের মাধ্যমে (ম্যাপল), জলের মাধ্যমে (নারকেল), বিস্ফোরক প্রক্রিয়ায় (মটরশুঁটি) এবং প্রাণীর মাধ্যমে (বেরি ও অন্যান্য রসালো ফল)।

পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা

ফল খাদ্য আঁশ (dietary fiber), ভিটামিন (বিশেষ করে ভিটামিন সি), জল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি চমৎকার উৎস। এই পুষ্টি উপাদানগুলো হজমে সহায়তা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে সতেজ রাখে।

বিশ্বব্যাপী কৃষি এবং খাদ্য ব্যবহার

অর্থনৈতিকভাবে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বজুড়ে ফল তাজা খাওয়ার পাশাপাশি জ্যাম, রস, ওয়াইন এবং বিয়ারের মতো বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, যা কৃষিশিল্পের একটি বড় অংশ।

খাদ্য-বহির্ভূত প্রয়োগ

খাবার হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ফলের নানাবিধ প্রয়োগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বেবেরি থেকে মোম (মোমবাতি), আফিম পপি থেকে ঔষধ, ধুন্দুল থেকে স্পঞ্জ, ওসেজ অরেঞ্জ থেকে পোকামাকড় তাড়ানোর দ্রব্য এবং নারকেলের ছোবড়া থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরি করা হয়। এমনকি শিল্পকলা, যেমন স্টিল লাইফ চিত্রকর্মেও ফলের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

উপসংহার

এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ফলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক সংজ্ঞাটিই এর প্রাথমিক কাঠামো গঠন করে। একটি সপুষ্পক উদ্ভিদের পরিপক্ক গর্ভাশয় হিসেবে এর শ্রেণিবিন্যাস—সরল, গুচ্ছ বা যৌগিক—এর বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। প্রচলিত রন্ধনসম্পর্কীয় ভূমিকার বাইরেও প্রকৃতি, পুষ্টি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ফলের বিশাল বৈচিত্র্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।

Shopping Cart
Scroll to Top