যদি আপনি সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা (fertility) বোঝা খুবই জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৬টি দম্পতির মধ্যে ১টি দম্পতি সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়ে, আর এর প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে পুরুষের দিক থেকেই।
ভালো খবর হচ্ছে – বেশিরভাগ পুরুষেরই শুক্রাণু তৈরি হয়। কিন্তু সেই শুক্রাণুর গুণমান (যেমন: সংখ্যা, গতি এবং আকার) ঠিক থাকলেই সন্তানের সম্ভাবনা বাড়ে।
শুধু শুক্রাণু তৈরি হলেই প্রজনন সম্ভব হয় না, তবে শুক্রাণুর স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সন্তান নেওয়ার সুযোগ অনেক বেশি বেড়ে যায়। চলুন জেনে নেই সুস্থ শুক্রাণুর কিছু প্রধান লক্ষণ এবং সেগুলো আপনার পিতৃত্ব যাত্রায় কীভাবে সাহায্য করতে পারে।
সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে সুস্থ শুক্রাণু কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
সন্তান ধারণের মূল ভিত্তি হলো সুস্থ শুক্রাণু। শক্তিশালী, সঠিকভাবে চলতে পারে এমন এবং ঠিকঠাক গঠনের শুক্রাণু ডিম্বাণু (egg)-এর কাছে পৌঁছে সেটিকে নিষিক্ত (fertilize) করতে পারে। এর মাধ্যমেই শুরু হয় সুস্থ গর্ভাবস্থা।
কিন্তু আপনি কি জানেন, কম শুক্রাণুর সংখ্যা বা শুক্রাণুর খারাপ ডিএনএ (DNA) গঠনের মতো সমস্যাই পুরুষের বন্ধ্যাত্বের (infertility) অন্যতম প্রধান কারণ?
তাই শুক্রাণুর গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া সন্তানের সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।
সুস্থ শুক্রাণুর লক্ষণগুলো কী কী?
শুধু শুক্রাণুর সংখ্যা বেশি থাকলেই হবে না—গুণগত মানও (quality) ভালো হতে হবে।
ঘরে বসে আপনি শুক্রাণুর রং ও গন্ধের মতো কিছু বিষয় দেখতে পারেন, তবে গতি (motility) ও ডিএনএ স্বাস্থ্য (DNA integrity) পরিক্ষা করার জন্য বিশেষ পরীক্ষা প্রয়োজন।
চলুন এখন বিভিন্ন দিক গুলো একে একে দেখি:
১. বীর্যর পরিমাণ (Semen volume)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বার বীর্যপাতের (ejaculation) সময় ১.৫ থেকে ৫.০ মিলিলিটার বীর্য হওয়া স্বাভাবিক।
এই পরিমাণ শুধু পরিমাণের বিষয় না – এতে এমন প্রোটিন ও পুষ্টি উপাদান থাকে যা শুক্রাণুকে রক্ষা করে এবং পুষ্টি দেয়।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে:
যদি পরিমাণ ১.৫ মিলিলিটারের কম হয়, তাহলে শুক্রাণু পরিবহণে বাধা (blockage) বা হরমোনের সমস্যা থাকতে পারে।
আবার যদি বেশি হয়, যেমন ৪.৫ মিলিলিটারের বেশি, তাহলে শুক্রাণু পাতলা হয়ে যেতে পারে, যা গুণমানে প্রভাব ফেলতে পারে।
২. শুক্রাণুর সংখ্যা (Sperm Count)
একজন পুরুষের বীর্যে প্রতি মিলিলিটারে ১৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকলে তা স্বাভাবিক বা সুস্থ ধরা হয়।
যদি প্রতি মিলিলিটারে শুক্রাণু ১৫ মিলিয়নের কম থাকে, তাহলে একে বলা হয় অলিগোস্পার্মিয়া (Oligospermia) বা শুক্রাণুর স্বল্পতা।
আর পুরো বীর্যপাতের মধ্যে মোট শুক্রাণুর সংখ্যা ৩৯ মিলিয়নের বেশি হলে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে ভালো থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আপনার জীবনযাত্রা (লাইফস্টাইল) শুক্রাণু উৎপাদনের উপর অনেক প্রভাব ফেলে—আপনি কী খান, কতটুকু শরীরচর্চা করেন, সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শুক্রাণুর গতি (Sperm Motility)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, কমপক্ষে ৪০% শুক্রাণু চলমান থাকতে হবে।
এর মধ্যে অন্তত ৩২% শুক্রাণু সামনে দিকে সোজা বা বড় বৃত্তে সাঁতার কাটার মতো গতি থাকতে হবে।
এছাড়া, প্রতি বীর্যপাতের সময় মোট চলমান শুক্রাণুর সংখ্যা (TMSC) যেন ২০ মিলিয়নের বেশি হয়।
ভালো গতি থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শুক্রাণুকে জরায়ুমুখের (cervix) শ্লেষ্মা ও নারীর প্রজনন পথে (reproductive tract) সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে হয় ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছাতে।
৪. শুক্রাণুর আকার ও গঠন (Sperm Morphology)
শুক্রাণুর গঠন (আকার ও আকৃতি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নির্ধারণ করে শুক্রাণুটি ডিম্বাণুকে ভেদ করে নিষিক্ত করতে পারবে কি না।
Kruger criteria (ক্রুগার মানদণ্ড) অনুযায়ী, অন্তত ৪% শুক্রাণুর গঠন একেবারে নিখুঁত হওয়া দরকার।
নিখুঁত গঠনের মানে হচ্ছে:
-
মাথার দৈর্ঘ্য: ৪.০-৫.০ মাইক্রোমিটার (μm)
-
মাথার প্রস্থ: ২.৫-৩.৫ মাইক্রোমিটার (μm)
-
মধ্য অংশ: ৭-৮ মাইক্রোমিটার লম্বা
-
লেজ: ৪৫ মাইক্রোমিটার লম্বা, যেন সোজা ও না বাঁকা হয়।
৫. বীর্যে ফ্রুক্টোজের ঘনত্ব (Fructose Concentration in Semen)
যেমনভাবে আমাদের চলাফেরার জন্য শক্তি দরকার, ঠিক তেমনিভাবে শুক্রাণুরও চলাফেরার জন্য শক্তি দরকার।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্রুক্টোজ (Fructose) নামের একধরনের চিনি শুক্রাণুর জ্বালানির কাজ করে।
স্বাভাবিকভাবে, প্রতি বীর্যপাতের মধ্যে ১৩ মাইক্রোমোল (μmol) বা তার বেশি ফ্রুক্টোজ থাকা উচিত।
এই ফ্রুক্টোজ তৈরি করে সেমিনাল ভেসিকল (seminal vesicle) নামের গ্রন্থি।
যদি এই ফ্রুক্টোজের মাত্রা কম হয়, তাহলে তা বোঝায় যে হয়তো ভেসিকল বন্ধ হয়ে গেছে, হরমোনের সমস্যা হয়েছে, বা শুক্রাণু যাওয়ার পথে কোনো বাধা আছে।
নিয়মিত টেস্ট করালে এসব সমস্যা আগে থেকেই ধরা যায়।
৬. শুক্রাণুর ডিএনএ গঠনের মান (Sperm DNA Integrity)
শুক্রাণুর ডিএনএ (DNA) হলো তার জেনেটিক তথ্যের বাক্স বা যন্ত্রপাতির সেট।
এই ডিএনএ যদি ভালো অবস্থায় থাকে, তাহলে তা সন্তান ধারণের জন্য ভালো।
ডিএনএ ফ্র্যাগমেন্টেশন ইনডেক্স (DFI) নামে একটি স্কোর থাকে।
-
যদি এই স্কোর ১৫% বা কম হয়, তাহলে তা আদর্শ মানে পড়ে।
-
কিন্তু ২৫% বা তার বেশি হলে তা চিন্তার বিষয়।
DFI বেশি হলে কী হতে পারে:
-
ডিম্বাণু নিষিক্ত হতে সমস্যা হতে পারে
-
ভ্রূণের উন্নয়ন ভালো হয় না
-
গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়
-
IVF বা টেস্টটিউব পদ্ধতির সফলতা কমে যেতে পারে
৭. বীর্যের পিএইচ মাত্রা (Semen pH Levels)
স্বাভাবিকভাবে, বীর্যের pH (অম্ল-ক্ষার মাত্রা) হওয়া উচিত ৭.২ থেকে ৮.০ এর মধ্যে।
এই ক্ষারীয় পরিবেশ শুক্রাণুর জন্য উপকারী:
-
এটি যোনিপথের অম্লীয় পরিবেশ থেকে শুক্রাণুকে রক্ষা করে
-
শুক্রাণুর চলাফেরা সহজ করে
-
শুক্রাণুকে টিকিয়ে রাখে, যাতে তারা ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে
যদি pH মাত্রা এই সীমার বাইরে হয়, তাহলে তা ইনফেকশন বা প্রজনন পদ্ধতির কোনো সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।
৮. শুক্রাণুর জীবনশক্তি (Sperm Vitality)
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন সুস্থ পুরুষের বীর্যে কমপক্ষে ৫৮% শুক্রাণু জীবিত থাকা উচিত।
চিকিৎসকেরা বিশেষ ধরনের রঞ্জন (staining) পদ্ধতির মাধ্যমে শুক্রাণুর জীবিত থাকা নির্ণয় করেন।
যদি শুক্রাণুর জীবনশক্তি কম হয়, তাহলে সাধারণত চলাফেরার ক্ষমতাও কমে যায় (motility)।
শুক্রাণুর Vitality-তে যেসব বিষয় প্রভাব ফেলতে পারে:
-
পরিবেশগত সমস্যা (যেমন দূষণ, তাপমাত্রা)
-
ভ্যারিকোসিল (Varicocele) – অর্থাৎ অণ্ডকোষে রক্তনালির ফোলা অবস্থা
-
কিছু ওষুধ বা মেডিকেশন
৯. বীর্যে শ্বেত রক্তকণিকার মাত্রা (White Blood Cell Levels in Semen)
সাধারণত, প্রতিমিলিলিটার বীর্যে ১০ লক্ষের (1 million) কম শ্বেত রক্তকণিকা (white blood cells) থাকা উচিত।
এর বেশি থাকলে তাকে বলে লিউকোসাইটোস্পারমিয়া (Leukocytospermia), যা নির্দেশ করে:
-
সংক্রমণ (Infection)
-
প্রদাহ (Inflammation)
-
ইমিউন বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কোনো সমস্যা
এই কারণে নিয়মিত বীর্য পরীক্ষা করানো খুব জরুরি, যাতে কোনো সমস্যা আগে থেকেই ধরা পড়ে এবং সন্তান ধারণে প্রভাব ফেলতে না পারে।
১০. বীর্যের রঙ ও গন্ধ (Semen Colour and Smell)
সুস্থ বীর্যের রং সাধারণত হয়:
-
হালকা সাদা (Whitish)
-
ছাই সাদা বা ধূসরাভ (Off-white or Grey-opal)
বীর্য প্রথমে একটু ঘন জেলের মতো থাকে, তবে ১৫-৩০ মিনিটের মধ্যে এটি তরল হয়ে যায় – এটি স্বাভাবিক।
গন্ধ সাধারণত হালকা এবং এক ধরনের ব্লিচ বা ক্লোরিনের মতো গন্ধ থাকতে পারে – এটিও স্বাভাবিক।
তবে নিচের যেকোনো রঙ বা লক্ষণ দেখা গেলে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন:
-
হলুদ বা সবুজ রঙ
-
লাল বা বাদামি রঙ
-
গোলাপি বা রক্তের চিহ্নযুক্ত বীর্য
এই সবগুলোই কোনো সংক্রমণ, রক্তপাত বা শারীরিক জটিলতার লক্ষণ।
যদি আপনার শুক্রাণুর গুণমান নিয়ে উদ্বেগ থাকে, কী করবেন?
আপনার যদি সন্তান ধারণে সমস্যা হচ্ছে বা আপনি শুক্রাণুর গুণগত মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তাহলে সবার প্রথমে একজন সাধারণ চিকিৎসকের (GP) সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
তারা আপনার ইতিহাস ও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে প্রয়োজন হলে ফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট বা বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করতে পারবেন।
বর্তমানে অনেক ক্লিনিকেই বাসায় বসেই শুক্রাণুর প্রাথমিক স্ক্রিনিং টেস্ট করার কিট পাওয়া যায়, যা প্রথম ধাপ হিসেবে সাহায্য করতে পারে।
শুক্রাণুর গুণগত মান উন্নত করার উপায়
যদিও সম্পূর্ণ শুক্রাণু বিশ্লেষণ করতে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের সহায়তা প্রয়োজন হয়, তবে আপনি নিজেও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে আপনার ফার্টিলিটি উন্নত করতে পারেন।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ পর্যন্ত ছোট ছোট উদ্যোগেও বড় ফলাফল আসতে পারে।
নিচে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:
✅ প্রতিদিন Impryl ফার্টিলিটি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন
-
Impryl হলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ফর্মুলা, যা পুরুষদের শুক্রাণুর ডিএনএ গুণমান ও কোষের মেটাবলিজম উন্নত করতে সাহায্য করে।
✅ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ খাবার খান
-
ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, বাদাম, সবুজ শাকসবজি এগুলো শরীরের কোষকে সুরক্ষা দেয় ও শুক্রাণুর শক্তি বাড়ায়।
✅ সপ্তাহে ৩-৪ দিন মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করুন
-
রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে শুক্রাণুর চলাফেরা ক্ষমতা (motility) বাড়াতে সাহায্য করে।
✅ ধূমপান বন্ধ করুন এবং ধোঁয়ার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন
-
সিগারেট শুক্রাণুর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
✅ সপ্তাহে ১৪ ইউনিটের মধ্যে অ্যালকোহল সীমাবদ্ধ রাখুন
-
অতিরিক্ত অ্যালকোহল টেস্টোস্টেরন হরমোন হ্রাস করতে পারে এবং শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা দেয়।
✅ স্ট্রেস কমানোর উপায় খুঁজে নিন
-
মেডিটেশন, ইয়োগা বা পর্যাপ্ত ঘুম স্ট্রেস কমিয়ে হরমোন ব্যালেন্স বজায় রাখতে সাহায্য করে।
✅ ঢিলেঢালা সুতি অন্তর্বাস পরুন
-
আঁটসাঁট পোশাক অণ্ডকোষের তাপমাত্রা বাড়ায়, যা শুক্রাণুর জন্য ক্ষতিকর।
✅ প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি পান করুন
-
শরীরকে হাইড্রেটেড রাখলে শুক্রাণু উৎপাদন ও গুণমান ভালো থাকে।
✅ অণ্ডকোষ অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে বিরত থাকুন
-
গরম পানির গোসল, সাউনা বা ল্যাপটপ কোলের ওপর রাখা এড়িয়ে চলুন।
✅ সঠিক ওজন বজায় রাখুন (BMI ১৮.৫-২৪.৯)
-
অতিরিক্ত ওজন হরমোন ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, যা শুক্রাণুর গুণমান কমিয়ে দেয়।
উপসংহার:
আপনার শুক্রাণুর স্বাস্থ্য উন্নত করা মানেই ভবিষ্যতের বাবা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, লাইফস্টাইল এবং প্রমাণিত সাপ্লিমেন্ট – সবকিছুর সম্মিলিত প্রয়োগেই আপনার ফার্টিলিটি উন্নত করা সম্ভব।