স্পার্ম কাউন্ট কম থাকা

অলিগোস্পার্মিয়া (Oligospermia): শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়া – কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

অলিগোস্পার্মিয়া হল এক ধরনের শারীরিক অবস্থা যেখানে পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে। এটি পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং প্রজনন অক্ষমতার কারণ হতে পারে।

সংজ্ঞা:
অলিগোস্পার্মিয়া এমন একটি অবস্থা যেখানে পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা প্রতি মিলিলিটার সেমেনে ১৫ মিলিয়ন বা তার কম থাকে। শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যেতে পারে, কারণ শুক্রাণু খুব কম থাকলে তাদের গর্ভাশয়ে পৌঁছানোর সুযোগ কমে যায়।

অলিগোস্পার্মিয়ার কারণ

অলিগোস্পার্মিয়ার কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে এবং কিছু কারণ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত থাকতে পারে।

১. জেনেটিক কারণ

  • কাইনফেল্টার সিনড্রোম: এটি একটি জেনেটিক সমস্যা যেখানে পুরুষের একাধিক এক্স ক্রোমোজোম থাকে। এর ফলে শুক্রাণু উৎপাদন কমে যায়।

  • ওয়াই-ক্রোমোজোম মাইক্রোডিলেশন: এই অবস্থায় পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোমে মাইক্রোডিলেশন (ছোট অংশের ক্ষতি) ঘটে, যার ফলে শুক্রাণু উৎপাদনে সমস্যা দেখা দেয়।

২. লাইফস্টাইল সম্পর্কিত কারণ

  • ধূমপান: ধূমপান শুক্রাণুর গুণগত মান এবং সংখ্যা কমাতে পারে।

  • অতিরিক্ত মদ্যপান: অতিরিক্ত মদ্যপান শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

  • মাদকদ্রব্য ব্যবহার: মাদকদ্রব্যের ব্যবহার শুক্রাণু গঠনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন বেশি ফ্যাট, চিনি, এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শুক্রাণুর উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

৩. পরিবেশগত কারণ

  • বিষাক্ত পদার্থ: নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ যেমন পেস্টিসাইড, কসমেটিক্স, এবং শিল্পকর্মের জন্য ব্যবহৃত টক্সিক পদার্থ শুক্রাণুর সংখ্যা কমাতে পারে।

  • কীটনাশক: কীটনাশকের ব্যবহার পুরুষের শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

  • অতিরিক্ত তাপমাত্রা: শরীরের তাপমাত্রা বেশি হয়ে গেলে শুক্রাণুর উৎপাদন কমে যায়, যেমন হট বাথ বা ল্যাপটপের ব্যবহার।

৪. চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণ

  • ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের হরমোনাল ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, যা শুক্রাণু উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।

  • ভারিকোসেল: পুরুষের জরায়ুর শিরায় রক্ত সঞ্চালন সমস্যার ফলে শুক্রাণুর গুণমান কমে যায়।

  • হরমোনাল সমস্যা: হরমোনের তারতম্য শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

  • সংক্রমণ: সংক্রমণ, বিশেষ করে পুরুষের প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ, শুক্রাণু গঠন ও সংখ্যা কমিয়ে দেয়।

  • আগের অস্ত্রোপচার: পুরুষদের প্রজনন অঙ্গের অস্ত্রোপচারের পর শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যেতে পারে।

৫. বয়স

বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যেতে পারে। সাধারণত, ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সের পুরুষদের শুক্রাণুর গুণমান ও সংখ্যা কমে যায়।

৬. মানসিক চাপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য

মানসিক চাপ পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত মানের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের ফলে হরমোনাল সমস্যা এবং শুক্রাণুর গুণমানের অবনতি হতে পারে, যা প্রজনন ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অলিগোস্পার্মিয়ার লক্ষণ

অলিগোস্পার্মিয়া এর কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ থাকে, যা পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যাওয়ার লক্ষণ

  • অবৈধ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে গর্ভধারণে সমস্যা: শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যায়, যার ফলে অবৈধ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে গর্ভধারণের সমস্যা হতে পারে।

  • অণ্ডকোষে ব্যথা বা ফোলাভাব: শুক্রাণু উৎপাদনের প্রক্রিয়া বা প্রজনন অঙ্গের সমস্যা থাকলে অণ্ডকোষে ব্যথা বা ফোলাভাব হতে পারে।

  • হরমোনাল পরিবর্তন: শুক্রাণু উৎপাদন কম হলে পুরুষের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন দেখা দিতে পারে, যেমন মুখ বা শরীরে হালকা লোম বৃদ্ধি বা পুরুষত্বহীনতা।

কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে

যদি কোনো পুরুষ দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভধারণে সমস্যা অনুভব করেন অথবা শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকে, তবে সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সাধারণত যদি ১ বছরের চেষ্টা সত্ত্বেও গর্ভধারণ না হয়, তবে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।

অলিগোস্পার্মিয়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

অলিগোস্পার্মিয়া নির্ণয় করতে কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন করা হয়।

সিমেন এনালাইসিস

  • প্রধান পরীক্ষা: সিমেন এনালাইসিস (স্পার্ম পরীক্ষা) হলো প্রধান পরীক্ষা, যা দিয়ে শুক্রাণুর সংখ্যা, গঠন এবং গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। যদি শুক্রাণুর সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন/মিলিলিটার থেকে কম হয়, তাহলে অলিগোস্পার্মিয়া ধরা পড়ে।

অন্যান্য পরীক্ষা

  • হরমোনাল পরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষা করে পুরুষের হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, যা শুক্রাণু উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।

  • জেনেটিক স্ক্রিনিং: যদি জেনেটিক কারণে অলিগোস্পার্মিয়া হয়, তবে বিশেষ ধরনের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হয়।

শারীরিক পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য মূল্যায়ন

  • শারীরিক পরীক্ষা: পুরুষের প্রজনন অঙ্গের শারীরিক পরীক্ষা করা হয় যাতে কোনো শারীরিক সমস্যা যেমন ভারিকোসেল বা অন্যান্য অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়।

  • ইতিহাস মূল্যায়ন: রোগীর মেডিক্যাল ইতিহাস, লাইফস্টাইল, খাদ্যাভ্যাস, এবং অন্যান্য সাধারণ অভ্যাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অলিগোস্পার্মিয়ার চিকিৎসা

অলিগোস্পার্মিয়ার চিকিৎসা বিভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে, যা রোগীর অবস্থান এবং কারণ অনুসারে নির্ধারণ করা হয়।

চিকিৎসা সংক্রান্ত চিকিৎসা

  • হরমোনাল থেরাপি: যদি হরমোনের তারতম্য বা অভাব থাকে, তবে হরমোনাল থেরাপি প্রদান করা হতে পারে। এটি শুক্রাণুর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।

  • Underlying conditions এর চিকিৎসা: অলিগোস্পার্মিয়ার কারণে যদি অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকে, যেমন ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড সমস্যা, তাহলে সেই সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন।

সার্জিক্যাল চিকিৎসা

  • ভারিকোসেল: যদি পুরুষের অণ্ডকোষে ভারিকোসেল (রক্তনালীতে সমস্যা) থাকে, তাহলে অস্ত্রোপচার করে এটি দূর করা যেতে পারে, যা শুক্রাণুর উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।

  • শুক্রাণুর গমন পথে বাধা দূর করা: যদি শুক্রাণুর গমন পথে কোনো বাধা থাকে, তাহলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা দূর করা যেতে পারে, যা শুক্রাণুর গমন সহজ করে।

লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন

  • সুষম খাদ্য: স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব। এটি শুক্রাণুর গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করে।

  • নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখে এবং হরমোনাল ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক।

  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ: ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান শুক্রাণুর গুণগত মান ও সংখ্যা কমাতে পারে, তাই এটি পরিহার করা উচিত।

সহায়িত প্রজনন প্রযুক্তি (ART)

  • IVF (ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন): IVF হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু বাইরে একটি পাত্রে মিলিত করে গর্ভধারণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

  • ICSI (ইনট্রাসাইটোপ্লাজমিক শুক্রাণু ইনজেকশন): এটি IVF এর একটি উন্নত পদ্ধতি, যেখানে একক শুক্রাণু ডিম্বাণুতে ইনজেক্ট করা হয়, বিশেষত যদি শুক্রাণুর সংখ্যা বা গুণমান কম থাকে।

বিকল্প চিকিৎসা

  • একুপাংচার: একুপাংচার হলো একটি প্রাচীন চাইনিজ চিকিৎসা পদ্ধতি যা শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় সূঁচ প্রবেশ করিয়ে প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। যদিও এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমর্থিত নয়, তবে কিছু মানুষ এর উপকারিতা অনুভব করেছেন।

  • অন্যান্য বিকল্প চিকিৎসা: বিভিন্ন প্রাকৃতিক চিকিৎসা যেমন হোমিওপ্যাথি বা হার্বাল চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এসবের কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত নয়।

অলিগোস্পার্মিয়া প্রতিরোধ

অলিগোস্পার্মিয়ার প্রতিরোধ করা সম্ভব, তবে এটি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এবং সচেতনতার মাধ্যমে সম্ভব।

স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল বজায় রাখা

  • সুষম খাদ্য: সুষম খাদ্য গ্রহণ, যা প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, শরীরের প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

  • নিয়মিত ব্যায়াম: শরীরের সুস্থতা বজায় রাখে এবং হরমোনাল ভারসাম্যকে ঠিক রাখে, যা শুক্রাণু উৎপাদনকে প্রভাবিত করে।

  • মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ কমানোর জন্য যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন করা যেতে পারে, যা হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে।

অবাঞ্ছিত উপাদান এড়িয়ে চলা

  • ধূমপান, মদ্যপান এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকা: এগুলো শুক্রাণু উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

  • পুরুষের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়মিত স্ক্রিনিং: পুরুষদের নিয়মিত প্রজনন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত, বিশেষত যদি গর্ভধারণে সমস্যা থাকে।

কখন পেশাদার সহায়তা নিতে হবে

  • দীর্ঘস্থায়ী বন্ধ্যাত্বের সমস্যা: যদি একজন পুরুষ দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভধারণে সমস্যা অনুভব করেন, তাহলে পেশাদার চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া উচিত।

  • প্রজনন বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিকের ভূমিকা: প্রজনন বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিকগুলি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসা প্রদান করতে পারে, যা সাহায্য করতে পারে।

উপসংহার

অলিগোস্পার্মিয়া একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা, এবং এর জন্য অনেক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গুণমান বাড়ানো সম্ভব, যা গর্ভধারণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতে পারে।

তবে, যদি কোনো সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে সময়মত পেশাদার সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ এবং সঠিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

Shopping Cart
Scroll to Top