ত্বকের অ্যালার্জি হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) এক ধরনের অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া, যেখানে নিরীহ কোনো পদার্থকেও শরীর ক্ষতিকর ভেবে আক্রমণ করে। সাধারণত আমাদের ইমিউন সিস্টেম ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের মতো ক্ষতিকারক জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে, কিন্তু অ্যালার্জির ক্ষেত্রে এটি চিংড়ি, বেগুন বা ধুলাবালির মতো সাধারণ জিনিসকেও বিপজ্জনক মনে করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর ফলেই ত্বকে নানা ধরনের অস্বস্তিকর উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন চুলকানি, লালচেভাব, ফোলা বা ফুসকুড়ি।
এটি একটি বহুল প্রচলিত স্বাস্থ্য সমস্যা, যা হালকা থেকে গুরুতর পর্যায়ে দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপীই এর প্রভাব রয়েছে এবং বঙ্গ অঞ্চলেও এর প্রবণতা লক্ষণীয়। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে হাঁপানি, একজিমা বা অ্যালার্জির ইতিহাস আছে, তাঁদের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। ছোটদের মধ্যে একজিমা সাধারণত বেশি দেখা যায়, আবার বড়দের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী আমবাত দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ত্বকের অ্যালার্জি শুধু শারীরিক অস্বস্তিই নয়, মানসিক চাপেরও কারণ হতে পারে। তীব্র চুলকানি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং প্রতিদিনের কাজকর্মে প্রভাব ফেলে। উপরন্তু, দৃশ্যমান র্যাশ বা দাগ অনেক সময় সামাজিক অস্বস্তি তৈরি করে। তাই ত্বকের অ্যালার্জি একটি সাধারণ কিন্তু অবহেলা না করার মতো স্বাস্থ্য সমস্যা।
ত্বকের অ্যালার্জির প্রকারভেদ
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস (Atopic Dermatitis) / একজিমা (Eczema)
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস, যা সাধারণত একজিমা নামেই পরিচিত, হলো ত্বকের একটি দীর্ঘস্থায়ী, চুলকানিযুক্ত প্রদাহজনিত অবস্থা। এটি এক ধরনের হাইপারসেনসিটিভিটি প্রতিক্রিয়া, যা প্রায়শই টাইপ ১ হাইপারসেনসিটিভিটির সাথে জড়িত থাকে। এই অবস্থায় ত্বকের প্রাকৃতিক সুরক্ষামূলক বাঁধা (স্কিন ব্যারিয়ার) দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে অ্যালার্জেন এবং উত্তেজক পদার্থগুলি সহজে ত্বকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, যার ফলস্বরূপ প্রদাহ দেখা দেয়।
লক্ষণাবলী:
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসের লক্ষণগুলি বয়সভেদে ভিন্ন হতে পারে:
-
নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে: শিশুদের ক্ষেত্রে একজিমা সাধারণত মুখ, মাথার ত্বক এবং বাহু ও পায়ের এক্সটেন্সর সারফেসে (যেমন, কনুই ও হাঁটুর বাইরের দিকে) লাল, জলীয় ফোসকাযুক্ত ফুসকুড়ি আকারে দেখা দেয়। এই ফুসকুড়িগুলি থেকে রস নিঃসৃত হতে পারে এবং পরে শুষ্ক হয়ে চামড়া ওঠে যেতে পারে। তীব্র চুলকানি শিশুদের মধ্যে বিরক্তি এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
-
বড় ও প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে: প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একজিমার প্রধান লক্ষণগুলো প্রায়শই ফ্লেক্সারাল এরিয়াতে (যেমন, কনুইয়ের ভাঁজে, হাঁটুর পেছনে, ঘাড়ের চারপাশে এবং কান ও চোখের আশেপাশে) দেখা যায়। এক্ষেত্রে ত্বক শুষ্ক, মোটা, এবং ধূসর বর্ণের হয়ে পড়ে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় লাইকেনিফিকেশন (Lichenification) বলা হয়। ত্বকের উপরিভাগ রুক্ষ এবং আঁশযুক্ত মনে হয়।
বিশেষ উল্লেখ:
অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা তীব্র চুলকানির কারণে ক্রমাগত ত্বক ঘষা বা চুলকানোর প্রবণতা দেখান। এর ফলে ত্বক ছিঁড়ে যাওয়া (excoriations) বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ত্বকের এই ফাটল বা ক্ষতি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য একটি প্রবেশ পথ তৈরি করে, যা সেকেন্ডারি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
সম্পর্ক:
একজিমা প্রায়শই অন্যান্য অ্যাটোপিক অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাকে “এটোপিক মার্চ” বলা হয়। এর অর্থ হলো, যে শিশুদের একজিমা হয়, তাদের পরবর্তীতে অ্যাজমা (হাঁপানি) এবং অ্যালার্জিক রাইনাইটিস (hay fever বা অ্যালার্জিক সর্দি) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই তিনটি অবস্থা প্রায়শই একই ব্যক্তির মধ্যে ক্রমান্বয়ে বা একই সাথে দেখা যায়।
আর্টিকেরিয়া (Urticaria) / আমবাত (Hives)
আর্টিকেরিয়া, যা সাধারণ্যে আমবাত বা হাইভস নামে পরিচিত, হলো ত্বকের এক ধরনের ফুসকুড়ি বা চাকা। এটি সাধারণত ইমিউনোগ্লোবুলিন ই (IgE) অ্যান্টিবডি-মধ্যস্থিত এক ধরনের টাইপ ১ হাইপারসেনসিটিভিটি প্রতিক্রিয়া। এই অবস্থায় শরীরের মাস্ট কোষ থেকে হিস্টামিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যার ফলে ত্বকের উপরিভাগে হঠাৎ করে ফুলে ওঠা, চুলকানিযুক্ত চাকা বা দানা দেখা দেয়।
লক্ষণাবলী:
আর্টিকেরিয়ার প্রধান লক্ষণ হলো লালচে, চুলকানিযুক্ত এবং উঁচু চাকা বা ওয়েল্ট (welts)। এই চাকাগুলি ত্বকে দ্রুত আবির্ভূত হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে বিলীন হয়ে আবার অন্য জায়গায় আবির্ভূত হতে পারে। এই দানা বা চাকাগুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলিতে চাপ দিলে মাঝখানের অংশ সাদা হয়ে যায় (blanching)। এগুলি আকারে ছোট পিনহেডের মতো হতে পারে অথবা বেশ বড় ও সংযুক্ত হয়ে প্ল্যাক (plaque) গঠন করতে পারে।
সময়কাল:
আর্টিকেরিয়াকে সময়কালের ভিত্তিতে দুটি প্রধান প্রকারে ভাগ করা যায়:
-
অ্যাকিউট আর্টিকেরিয়া: এটি এমন এক ধরনের আমবাত যা ছয় সপ্তাহের কম সময় ধরে স্থায়ী হয়। সাধারণত, এটি নির্দিষ্ট কোনো কারণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দেয়, যেমন কিছু খাবার (বাদাম, চিংড়ি, ডিম), ঔষধ (যেমন ব্যথানাশক), পোকা বা মশার কামড়, সংক্রমণ (যেমন ভাইরাসজনিত অসুস্থতা), অথবা নির্দিষ্ট কোনো শারীরিক সংস্পর্শ। এর কারণ প্রায়শই সনাক্ত করা সহজ এবং চিকিৎসা দিলে দ্রুত আরোগ্য হয়।
-
ক্রনিক আর্টিকেরিয়া: যদি আমবাত ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে স্থায়ী হয়, তবে তাকে ক্রনিক আর্টিকেরিয়া বলা হয়। এর কারণ নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন হতে পারে এবং এটি প্রায়শই কোনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যগত অবস্থার সাথে যুক্ত থাকে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি অটোইমিউন প্রকৃতির হতে পারে, যেখানে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত ত্বকের টিস্যুকে আক্রমণ করে।
সম্পর্ক:
অ্যানজিওএডিমা (Angioedema) হলো আর্টিকেরিয়ার একটি গভীরতর এবং কখনো কখনো আরও গুরুতর রূপ। আর্টিকেরিয়া যেখানে ত্বকের উপরিভাগের ডার্মিস স্তরে প্রভাব ফেলে, সেখানে অ্যানজিওএডিমার ক্ষেত্রে ফোলাভাব ত্বক, শ্লেষ্মা ঝিল্লি বা সাবমিউকোসাতে (ত্বকের গভীর স্তর) দেখা যায়। এই ফোলাভাব সাধারণত মুখ, চোখ, ঠোঁট, জিহ্বা, অথবা শ্বাসযন্ত্রের মতো নরম টিস্যুর স্থানগুলিতে হয়। গুরুতর অ্যানজিওএডিমা, বিশেষত যদি জিহ্বা বা শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়, তবে তা শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে এবং এটি একটি জরুরি অবস্থা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, কারণ এটি এয়ারওয়ে ব্লক করে মারাত্মক হতে পারে। আর্টিকেরিয়ার সাথে অ্যানজিওএডিমাও দেখা যেতে পারে।
সংস্পর্শ ডার্মাটাইটিস (Contact Dermatitis)
সংস্পর্শ ডার্মাটাইটিস হলো ত্বকের একটি প্রদাহজনিত অবস্থা, যা ত্বক কোনো নির্দিষ্ট পদার্থ (যা অ্যালার্জেন বা ইরিট্যান্ট হতে পারে) এর সরাসরি সংস্পর্শে আসার কারণে সৃষ্টি হয়। এটি মূলত টাইপ IV হাইপারসেনসিটিভিটি প্রতিক্রিয়া, যা বিলম্বিত-টাইপ হাইপারসেনসিটিভিটি নামেও পরিচিত, অর্থাৎ সংস্পর্শের পর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে কিছুটা সময় লাগে।
প্রকারভেদ ও লক্ষণ:
-
অ্যালার্জিক কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস (ACD):
এটি নির্দিষ্ট অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট একটি বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া। সাধারণত, অ্যালার্জেনের সংস্পর্শের ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর ত্বকে লক্ষণগুলি আবির্ভূত হয়। এর প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে তীব্র চুলকানি, লালভাব, ছোট ফোসকা বা বড় ফোস্কা (vesicles or bullae)। ত্বকের যে অংশে অ্যালার্জেনের সংস্পর্শ ঘটেছিল, সেই স্থানটিতেই প্রায়শই একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতির র্যাশ দেখা যায়। সাধারণ অ্যালার্জেনগুলির মধ্যে রয়েছে নিকেল (গয়না বা জিপারে ব্যবহৃত), সুগন্ধি, রাবার এবং কিছু নির্দিষ্ট উদ্ভিদ (যেমন বিষ আইভি)। -
ইরিট্যান্ট কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস (ICD):
এটি অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে ত্বকের সরাসরি ক্ষতিসাধনের কারণে ঘটে, অর্থাৎ এটি একটি নন-অ্যালার্জিক প্রদাহ। শক্তিশালী ইরিট্যান্টের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক হতে পারে, কিন্তু হালকা ইরিট্যান্টের বারবার সংস্পর্শে আসার কারণে প্রতিক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। ইরিট্যান্ট কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস প্রায়শই ব্যথাযুক্ত হয় এবং আক্রান্ত স্থানে জ্বালাপোড়া ও শুষ্কতার অনুভূতি থাকে। হাত হলো ICD এর সবচেয়ে সাধারণ স্থান, কারণ ডিটারজেন্ট, সোপ, সলভেন্ট, এবং অ্যাসিড বা ক্ষারযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের মতো বিভিন্ন ইরিট্যান্টের সংস্পর্শে হাত প্রায়শই আসে। -
ফটোঅ্যালার্জিক কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিস (Photoallergic Contact Dermatitis):
এই ধরনের ডার্মাটাইটিস তখন দেখা দেয় যখন কোনো পদার্থ (যেমন কিছু সানস্ক্রিন, আফটারশেভ লোশন বা নির্দিষ্ট ঔষধ) ত্বকে প্রয়োগ করার পর সেটি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকে থাকা এই পদার্থটিকে এমন একটি কাঠামোতে পরিবর্তন করে যা ইমিউন সিস্টেমের দ্বারা অ্যালার্জেন হিসাবে চিহ্নিত হয়। এর ফলস্বরূপ, সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসা স্থানে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যার লক্ষণগুলি অ্যালার্জিক কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসের অনুরূপ হতে পারে, যেমন লালচে ভাব, চুলকানি এবং ফোসকা।