ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন হলো যোনি এবং ভালভার একটি ছত্রাকজনিত সংক্রমণ। এটি ক্যানডিডা (Candida) নামক এক প্রকার ইস্টের, বিশেষ করে ক্যানডিডা অ্যালবিকানস (Candida albicans) এর অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে। এটি মহিলাদের মধ্যে একটি অত্যন্ত সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৭৫% মহিলা তাদের জীবনে অন্তত একবার এই ইনফেকশনের সম্মুখীন হন।
Table of Contents
Toggleগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনকে সাধারণত যৌনবাহিত রোগ (Sexually Transmitted Infection – STI) হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তবে, ইস্টের সংক্রমণ যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে সঙ্গীর দেহে স্থানান্তরিত হতে পারে। এই আর্টিকেলটিতে ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের কারণ, সাধারণ ও জটিল লক্ষণসমূহ, বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ইস্ট ইনফেকশনের প্রধান কারণসমূহ (Causes of Yeast Infection)
যোনিতে ইস্ট ইনফেকশন মূলত কিছু নির্দিষ্ট কারণে শরীরের ছত্রাক নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে ঘটে থাকে। নিচে এর প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:
ক্যানডিডা ছত্রাকের অতিরিক্ত বৃদ্ধি (Overgrowth of Candida Fungus)
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ক্যানডিডা অ্যালবিকানস (Candida albicans) নামক এক প্রকার ইস্ট বা ছত্রাকের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। সাধারণত, মহিলাদের যোনিতে সীমিত পরিমাণে ইস্ট এবং কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিকভাবেই থাকে। ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) নামক ব্যাকটেরিয়া এই ইস্টের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু কোনো কারণে এই ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে গেলে বা কার্যকারিতা হ্রাস পেলে ইস্টের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ (Risk Factors)
কিছু নির্দিষ্ট অবস্থা বা অভ্যাস ইস্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়:
- অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার: বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে তা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি যোনির উপকারী ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে ফেলে। এর ফলে ইস্টের বৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে এবং ইনফেকশন দেখা দেয়।
- হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ বা হরমোন থেরাপির কারণে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে ইস্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে। হরমোনের এই পরিবর্তন যোনির স্বাভাবিক পরিবেশে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে, যা ইস্টের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস: রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে তা ইস্টের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের যোনি স্রাব এবং মূত্রে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকায় ক্যানডিডা ছত্রাক সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম: এইচআইভি (HIV), কেমোথেরাপি বা অন্য কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেলে শরীর ইস্টের বৃদ্ধিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এর ফলে ইনফেকশনের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
- অন্যান্য কারণ: এছাড়াও আরও কিছু বিষয় ইস্ট ইনফেকশনের কারণ হতে পারে, যেমন—দীর্ঘ সময় ধরে ভেজা বা অপরিষ্কার কাপড় পরে থাকা, যোনি পরিষ্কারের জন্য ডুশিং (Douching) পদ্ধতি ব্যবহার করা, সুগন্ধযুক্ত প্যাড বা ট্যাম্পনের মতো পণ্য ব্যবহার এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ। এই অভ্যাসগুলো যোনির স্বাভাবিক পিএইচ (pH) ভারসাম্য নষ্ট করে ইস্টের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ইস্ট ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণ (Common Symptoms of Yeast Infection)
ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষণগুলো এর তীব্রতার ওপর নির্ভর করে হালকা বা গুরুতর হতে পারে। নিচে এর প্রাথমিক এবং জটিল লক্ষণগুলো আলোচনা করা হলো:
প্রাথমিক এবং সাধারণ লক্ষণ
ইস্ট ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
- চুলকানি ও অস্বস্তি: যোনি এবং এর বাইরের অংশ, যা ভালভা নামে পরিচিত, সেখানে তীব্র চুলকানি, জ্বালাপোড়া এবং অস্বস্তি অনুভব করা।
- ঘন সাদা স্রাব: পনিরের মতো দেখতে ঘন, সাদা এবং গন্ধহীন যোনিস্রাব নির্গত হওয়া।
- জ্বালা বা ব্যথা: প্রস্রাবের সময় অথবা যৌন মিলনের সময় যোনিতে জ্বালা বা ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- লালভাব ও ফোলা: যোনির বাইরের অংশ বা ভালভা লালচে হয়ে যাওয়া এবং কিছুটা ফুলে যাওয়া।
জটিল বা গুরুতর ইনফেকশনের লক্ষণ (Symptoms of Complicated Infection)
কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশনটি জটিল রূপ ধারণ করতে পারে। গুরুতর ইনফেকশনের লক্ষণগুলো হলো:
- ত্বকে ফাটল বা ঘা: তীব্র চুলকানি এবং ফোলাভাবের কারণে যোনির সংবেদনশীল ত্বকে ফাটল ধরা বা ছোট ছোট ঘা তৈরি হওয়া।
- পুনরাবৃত্তিমূলক ইনফেকশন (Recurrent VVC): যদি বছরে চার বা তার বেশিবার ইস্ট ইনফেকশন হয়, তবে একে পুনরাবৃত্তিমূলক ভ্যাজাইনাল ক্যান্ডিডিয়াসিস (Recurrent VVC) বলা হয়, যা একটি জটিল অবস্থা।
- অত্যধিক লালভাব এবং ফোলা: সাধারণ ইনফেকশনের চেয়ে অনেক বেশি লালভাব এবং যোনিপথ মারাত্মকভাবে ফুলে ওঠা।
কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি? (When to See a Doctor?)
যদিও ইস্ট ইনফেকশন একটি সাধারণ সমস্যা, কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন:
- প্রথমবার লক্ষণ দেখা দিলে: যদি আপনি প্রথমবারের মতো ইস্ট ইনফেকশনের উপসর্গের সম্মুখীন হন, তবে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ, অন্য কোনো গুরুতর সমস্যার লক্ষণও একই রকম হতে পারে।
- ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) ওষুধে কাজ না হলে: ফার্মেসি থেকে কেনা অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা সাপোজিটর ব্যবহারের পরেও যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
- অন্যান্য উপসর্গ থাকলে: ইস্ট ইনফেকশনের সাধারণ উপসর্গের সাথে যদি জ্বর, কাঁপুনি, তলপেটে বা পিঠে ব্যথা অথবা বমি বমি ভাব দেখা দেয়, তবে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
- গর্ভাবস্থায় লক্ষণ দেখা দিলে: গর্ভবতী অবস্থায় যেকোনো ধরনের যোনি সংক্রমণ বা অস্বস্তির জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলা আবশ্যক, কারণ কিছু ওষুধ গর্ভাবস্থায় নিরাপদ নাও হতে পারে।
- অন্যান্য ইনফেকশনের সন্দেহ হলে: ইস্ট ইনফেকশনের কিছু লক্ষণ ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস (Bacterial Vaginosis – BV) বা যৌনবাহিত রোগ (Sexually Transmitted Infection – STI) এর মতো দেখতে হতে পারে। তাই উপসর্গগুলোর সঠিক কারণ জানতে এবং সঠিক চিকিৎসা পেতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়া (Diagnosis Process)
সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন সঠিকভাবে নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার সাধারণত দুটি প্রধান পদ্ধতির মাধ্যমে এই রোগটি শনাক্ত করেন:
শারীরিক পরীক্ষা (Physical Examination)
প্রাথমিকভাবে, ডাক্তার আপনার রোগের ইতিহাস এবং উপসর্গগুলো সম্পর্কে জানতে চাইবেন। এরপর তিনি একটি শারীরিক পরীক্ষা করবেন, যার মধ্যে শ্রোণী অঞ্চলের (pelvic) পরীক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। এই পরীক্ষার সময়, ডাক্তার আপনার ভালভা বা যোনির বাইরের অংশ এবং যোনিপথের ভেতরের অংশ সাবধানে পর্যবেক্ষণ করবেন। তিনি ইনফেকশনের লক্ষণ যেমন—লালভাব, ফোলাভাব, ত্বকে ফাটল এবং স্রাবের ধরন ও পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখবেন।
স্রাবের নমুনা পরীক্ষা (Sample of Discharge)
রোগ নিশ্চিত করার জন্য, ডাক্তার যোনি থেকে স্রাবের একটি নমুনা সংগ্রহ করতে পারেন। এই নমুনাটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়:
- মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা: সংগৃহীত নমুনাটি মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে ক্যানডিডা ছত্রাকের কোষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। এটি ইস্ট ইনফেকশন শনাক্ত করার একটি দ্রুত এবং কার্যকর পদ্ধতি।
- কালচার টেস্ট: যদি আপনার বারবার ইস্ট ইনফেকশন (recurrent infection) হতে থাকে অথবা প্রচলিত চিকিৎসায় ভালো ফল না পাওয়া যায়, তবে ডাক্তার একটি কালচার টেস্ট করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন প্রজাতির ক্যানডিডা ছত্রাক সংক্রমণের জন্য দায়ী, তা শনাক্ত করা হয়, যা সঠিক ঔষধ নির্বাচনে সহায়তা করে।
ইস্ট ইনফেকশনের আধুনিক চিকিৎসা (Modern Treatment for Yeast Infection)
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশনের চিকিৎসা নির্ভর করে সংক্রমণের তীব্রতা এবং এটি কত ঘন ঘন হচ্ছে তার ওপর। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের কার্যকরী পদ্ধতি রয়েছে।
ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) চিকিৎসা
সাধারণ বা হালকা ইস্ট ইনফেকশনের জন্য ওভার-দ্য-কাউন্টার (অর্থাৎ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া) ঔষধ সহজলভ্য। এগুলি সাধারণত অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রকৃতির হয় এবং বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়:
- ক্রিম এবং অয়েন্টমেন্ট: যোনির বাইরের ও ভেতরের অংশে লাগানোর জন্য।
- সাপোজিটরি: যোনিপথের ভেতরে প্রবেশ করানোর জন্য ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল।
বহুল ব্যবহৃত কিছু ওটিসি (OTC) ওষুধের মধ্যে রয়েছে মাইকোনাজোল (Miconazole) এবং ক্লোট্রিমাজোল (Clotrimazole)। এই ঔষধগুলো সাধারণত ১ দিন, ৩ দিন বা ৭ দিনের কোর্সে ব্যবহার করতে হয়। প্যাকেজের গায়ে থাকা নির্দেশাবলী অনুযায়ী সঠিক নিয়মে ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা জরুরি।
প্রেসক্রিপশন ওষুধ (Prescription Medications)
যদি OTC চিকিৎসায় কাজ না হয় বা ইনফেকশনটি গুরুতর হয়, তবে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন ওষুধের পরামর্শ দেন।
- মুখে খাওয়ার ওষুধ (Oral Antifungal): এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ফ্লুকোনাজল (Fluconazole), যা সাধারণত একটিমাত্র ডোজ হিসেবে নিতে হয়। এটি বেশ সুবিধাজনক এবং কার্যকর।
- জটিল ইনফেকশনের চিকিৎসা: গুরুতর বা জটিল ইনফেকশনের ক্ষেত্রে, ডাক্তার একাধিক ডোজ ফ্লুকোনাজল অথবা দীর্ঘ সময় ধরে যোনিতে ব্যবহারের জন্য কোনো শক্তিশালী অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিমের পরামর্শ দিতে পারেন।
পুনরাবৃত্তিমূলক ইনফেকশনের চিকিৎসা (Treatment for Recurrent Infections)
যাদের বছরে চার বা তার বেশিবার ইস্ট ইনফেকশন হয়, তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। একে মেইনটেন্যান্স থেরাপি (Maintenance Therapy) বলা হয়।
- দীর্ঘমেয়াদী মেডিকেশন প্ল্যান: এই পদ্ধতিতে, প্রাথমিক সংক্রমণ নিরাময়ের পর আবারও সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ঔষধের কোর্স দেওয়া হয়।
- সাপ্তাহিক ঔষধ: ডাক্তার রোগীকে ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে প্রতি সপ্তাহে একবার ফ্লুকোনাজল (Fluconazole) খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন অথবা সপ্তাহে একবার সাপোজিটরি ব্যবহার করতে বলতে পারেন।
ঘরোয়া প্রতিকার ও প্রতিরোধ (Home Remedies and Prevention)
আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে ইস্ট ইনফেকশনের লক্ষণ উপশম করা ও ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব।
ঘরোয়া প্রতিকার (Home Remedies)
কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ইস্ট ইনফেকশনের অস্বস্তি কমাতে সহায়ক হতে পারে, তবে গুরুতর পরিস্থিতিতে এগুলো ডাক্তারের পরামর্শের বিকল্প নয়।
- প্রোবায়োটিক দই: প্রোবায়োটিকযুক্ত, বিশেষ করে ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) সমৃদ্ধ দই খাওয়া শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য ফেরাতে সাহায্য করে। কেউ কেউ টক দই সরাসরি যোনিপথের বাইরের অংশে ব্যবহার করে থাকেন, যা চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া কমাতে পারে।
- বোরিক অ্যাসিড সাপোজিটরি: পুনরাবৃত্তিমূলক ইস্ট ইনফেকশনের ক্ষেত্রে বোরিক অ্যাসিড সাপোজিটরি একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে। তবে এটি অবশ্যই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এবং সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। এটি মুখে খাওয়া যাবে না এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটি নিরাপদ নয়।
- অন্যান্য ঘরোয়া পদ্ধতির কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা: টি ট্রি অয়েল বা নারকেল তেলের মতো অন্যান্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকারের কথা শোনা গেলেও, এগুলোর কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সীমিত। তাই যেকোনো প্রতিকার ব্যবহারের আগে এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।
প্রতিরোধের উপায় (Prevention Tips)
কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ইস্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়:
- সুতির অন্তর্বাস পরা: বাতাস চলাচল করতে পারে এমন সুতির অন্তর্বাস পরিধান করুন। সিনথেটিক কাপড়ের অন্তর্বাস আর্দ্রতা ধরে রাখে, যা ইস্টের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
- ভেজা বা টাইট পোশাক এড়িয়ে চলা: ওয়ার্কআউট বা সাঁতার কাটার পর যত দ্রুত সম্ভব ভেজা পোশাক পরিবর্তন করুন। অতিরিক্ত টাইট বা আঁটসাঁট পোশাক পরা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি বায়ু চলাচল ব্যাহত করে।
- ডুশিং এবং সুগন্ধিযুক্ত পণ্য পরিহার করা: ডুশিং যোনিপথের স্বাভাবিক পিএইচ (pH) ভারসাম্য নষ্ট করে এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া, সুগন্ধিযুক্ত প্যাড, টয়লেট পেপার, বা ফেমিনিন ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলোতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ত্বকে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ: চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে একটি সুষম খাদ্য তালিকা অনুসরণ করুন। আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, তবে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি, কারণ উচ্চ শর্করা ইস্টের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ভুল ধারণা ও সঠিক তথ্য (Myths and Facts)
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সঠিক তথ্য জানা থাকলে এই সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হয়।
- ভুল ধারণা ১: ইস্ট ইনফেকশন শুধুমাত্র যৌন সংসর্গের মাধ্যমে হয়।
- সঠিক তথ্য: এটি একটি সাধারণ ভুল ধারণা। ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন যৌনবাহিত রোগ (STI) নয়। এটি মূলত যোনিতে থাকা ক্যানডিডা ছত্রাকের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে হয়। যদিও যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে এটি সঙ্গীর মধ্যে ছড়াতে পারে, তবে এটি সংক্রমণের প্রধান কারণ নয় এবং যৌনভাবে সক্রিয় নন এমন মহিলাদেরও এই ইনফেকশন হতে পারে।
- ভুল ধারণা ২: দই ব্যবহার করলেই ইনফেকশন পুরোপুরি সেরে যায়।
- সঠিক তথ্য: প্রোবায়োটিকযুক্ত টক দই খাওয়া বা বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করা চুলকানির মতো হালকা উপসর্গ কমাতে সহায়ক হতে পারে, কারণ এটি উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য ফেরাতে সাহায্য করে। তবে এটি ইনফেকশন সারানোর জন্য কোনো নিশ্চিত বা স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা নয়। পুরোপুরি নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধই সবচেয়ে কার্যকর।
- ভুল ধারণা ৩: এটি কেবল অপরিষ্কার থাকার কারণে হয়।
- সঠিক তথ্য: যদিও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে ইস্ট ইনফেকশন শুধু অপরিষ্কার থাকার ফল নয়। এর মূল কারণ হলো শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হরমোনের পরিবর্তন, ডায়াবেটিস বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো কারণে যোনিতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে গেলে ইস্টের বৃদ্ধি ঘটে, যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন: সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কি ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে?
হ্যাঁ, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ইস্ট ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের ক্ষতিকর জীবাণুর পাশাপাশি যোনিতে থাকা উপকারী ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করে। এই উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো যোনির পিএইচ ও জীবাণুর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যখন এদের সংখ্যা কমে যায়, তখন ক্যান্ডিডা ইস্ট অতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পায়, ফলে ইস্ট ইনফেকশন হয়।
পিরিয়ডের সময় কি ইস্ট ইনফেকশন বাড়ে বা কমে?
মাসিকের ঠিক আগের হরমোনগত পরিবর্তন এবং যোনির pH লেভেলের পরিবর্তন ইস্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মাসিকের সময় ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পনের কারণে যোনিচত্বর আরো বেশি আর্দ্র ও উষ্ণ হয়ে ওঠে, যা ইস্টের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এর ফলে উপসর্গগুলো যেমন চুলকানি বা জ্বালাপোড়া আরও তীব্র হতে পারে।
ইস্ট ইনফেকশনে খাদ্যাভ্যাসের কোনো ভূমিকা আছে কি?
হ্যাঁ, খাদ্যাভ্যাস ইস্ট ইনফেকশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- চিনিযুক্ত খাবার ইস্টের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।
- অন্যদিকে, প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন চিনিমুক্ত টক দই, যোনির উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে, যা ইস্ট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
গর্ভকালীন ইস্ট ইনফেকশন কি নিরাপদ? এর চিকিৎসা কী?
গর্ভাবস্থায় ইস্ট ইনফেকশন হওয়া একটি সাধারণ ঘটনা এবং এটি সাধারণত গর্ভের শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে এটি মায়ের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত নিরাপদ:
- অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা
- সাপোজিটরি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে গর্ভাবস্থায় মুখে খাওয়ার অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ সাধারণত এড়িয়ে চলা উচিত। চিকিৎসা শুরুর আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
পুরুষদের কি ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে?
হ্যাঁ, পুরুষদেরও ইস্ট ইনফেকশন হতে পারে, যা পেনাইল ক্যানডিডিয়াসিস বা ক্যানডিডা ব্যালানাইটিস নামে পরিচিত। এর সাধারণ উপসর্গ:
- লিঙ্গের অগ্রভাগে চুলকানি বা জ্বালাপোড়া
- লালচে ভাব বা ফুসকুড়ি
- সাদা ঘন স্রাব
ঝুঁকিপূর্ণ কারণ:
- অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি
- খৎনা না করা
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
- দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
সারসংক্ষেপ (Summary)
ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন একটি সাধারণ ছত্রাকজনিত রোগ, যা ক্যানডিডা নামক ইস্টের অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে হয়ে থাকে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, হরমোনের পরিবর্তন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো যোনিতে চুলকানি, জ্বালাপোড়া এবং সাদা, পনিরের মতো স্রাব।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওভার-দ্য-কাউন্টার অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মুখে খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে এর সফল চিকিৎসা সম্ভব। কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যেমন—সুতির অন্তর্বাস পরা, সুগন্ধিযুক্ত পণ্য এড়িয়ে চলা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা যায়। যদি প্রথমবারের মতো উপসর্গ দেখা দেয়, চিকিৎসায় উন্নতি না হয় অথবা বারবার ইনফেকশন হতে থাকে, তবে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।